মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও ৬-দফা আন্দোলন – ডা. এস এ মালেক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি ৬৬ সালে তার ৬-দফা ঘোষণাটা প্রাঞ্জলভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে না পারতেন, তাহলে ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান হতো না। আর যদি তা না হতো, তাহলে তার অবস্থা কী হতো তা বলাই বাহুল্য। গণঅভ্যুত্থান না হলে ৭০ সালে ইয়াহিয়াকে নির্বাচন দিতে তিনি বাধ্য করতে পারতেন না।
![মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও ৬-দফা আন্দোলন - ডা. এস এ মালেক [ ১১০-১১৩]](https://politicsgurukul.com/wp-content/uploads/2022/03/6-points-৬-দফা-3-300x230.jpg)
৬ দফাকে যদি তিনি নির্বাচনের ম্যান্ডেট হিসেবে ব্যবহার করতে না পারতেন, তাহলে পূর্ববাংলার ১৬৯ আসনের ভেতর ১৬৭টি আসন লাভ করা সম্ভব হতো না। পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি হিসেবে ৭০-এর নির্বাচনের ফলে তিনি যে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তাও অর্জন সম্ভব ছিল না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ৬-দফা আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল।
[ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও ৬-দফা আন্দোলন – ডা. এস এ মালেক ]
১৯৬৬ সালে লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাঙালির মুক্তিসনদ ৬-দফা ঘোষণা করলেন, তখন তা এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের শাসকরা এক রকম ধরেই নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ওই কর্মসূচির লক্ষ্য বিচ্ছিন্নতাবাদ। পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের কাঠামো থেকে আলাদা করাই ছিল এ ৬-দফার মূল লক্ষ্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যুক্তি ছিল পাকিস্তানকে যদি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তাহলে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প নেই।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা ও ব্যবসায়ী এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে শোষণপ্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তাতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নটা খুব সহজেই প্রকট আকার ধারণ করে । এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে বেশকিছু বাঙালি নেতৃত্ব প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন ।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত ৪ জন সংসদসদস্য, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কঠোর ভাষায় পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলার যুবকদের বুকের রক্তে যে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, সে কথা বিশেষভাবে বলা হয়, কীভাবে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পূর্ববাংলার জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তাও বিশদভাবে আলোচনা হয়।
পাকিস্তানের করাচি, লাহোর ও ইসলামাবাদে পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় পর পর তিনটি রাজধানী গড়ে উঠলেও ঢাকা একটা উপশহর হিসেবেই থেকে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের কোনো একটা প্রধান কার্যালয় সেখানে স্থান পায় না। আমদানি, রপ্তানি, ইস্যুরেন্স, বাণিজ্যসহ সবকিছু পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাংলাদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাও কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হতে থাকে ।
বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর বিপুল অর্থ একতরফাভাবে পশ্চিম পাকিস্ত ানের জনগণ পেতে থাকে। কেননা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে পূর্ববাংলার প্রতিনিধিত্ব তখন ছিল না বলেই মনে হয়। বিধায় প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজন পেতে থাকে, বঞ্চিত হয় পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান সরকার কৌশল করে ডিফেন্স বাজেট প্রায় গোপনীয়ভাবে ব্যয় করতে থাকে।
প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে বাংলাদেশের জনগণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে বাধ্য হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ববাংলার জনগণ যখন বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ, নিরাপত্তাবোধে আতঙ্কিত তখনই শেখ মুজিব লাহোরে তার ৬-দফা ঘোষণা করেন। ৬৫ সালে যুদ্ধ চলাকালে ভারত তার রাষ্ট্রনীতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ চালায়নি বলতে গেলে ভারতের ওই ধরনের সিদ্ধান্তই ছিল পূর্ববাংলার জনগণের রক্ষাকবচ।
পাকিস্তান তার সব সামরিক শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধে ব্যয় করে। পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অথচ ডিফেন্স বাজেটের এক বিরাট অংশ পূর্ববাংলার জনগণকে দিতে হতো। একদিকে চরম বৈষম্যমূলক বাস্তবতা অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তার নিদারুণ সঙ্কট, ঠিক এরূপ এক বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু লাহোরে তার ৬-দফা ঘোষণা করেন।

পশ্চিম পাকিস্ত ানের প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, আর তারা শেখ মুজিবকে যেভাবেই দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করুক না কেন- বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধু সহজ বোধগম্য ভাষায় ৬-দফার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন, তখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া প্রায় সব জনগণ গভীর আগ্রহে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করল ও অকুণ্ঠ সমর্থন জানালো ৬৬ থেকে ৬৯ এই তিন বছরেই বাংলাদেশে এক গণজাগরণের পূর্বাবস্থা সৃষ্টি হলো।
বিশেষ করে ৬-দফার প্রত্যুত্তরে জেনারেল আইয়ুব যখন অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন এবং শেখ মুজিবকে শাস্তি পেতেই হবে বলে ঘোষণা দিলেন তখন বাংলাদেশের মানুষ তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল । বাংলাদেশে নিযুক্ত আইয়ুব খানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত মুসলিম লীগের নেতা তখন গভর্নর। আইয়ুবকে খুশি করার জন্য তিনি ঘোষণা দিলেন শেখ মুজিবকে আর দিনের আলো দেখতে দেয়া হবে না এবং সত্যি সত্যিই তার বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দেয়া হলো।
মোনায়েমের বাহিনী তাকে এক শহর থেকে অন্য শহর, এক আদালত থেকে আর এক আদালতে টানাহেঁচড়া করতে লাগল । অবস্থা যখন চরম তখন কেন্দ্রীয় সরকার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার চক্রান্ত করল তিনি যখন কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক তখন তাকে আগরতলা মামলার এক নাম্বার আসামি করে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়।
তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সেখানে ক্যামেরা ট্রায়াল করে শেখ মুজিবের ফাঁসি কার্যকর করা কর্মরত নিরাপত্তা বাহিনী সরাসরি তাকে গুলি করল। ভাগ্যগুণে মুজিব বেঁচে গেলেন। সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলেন। ক্যান্টনমেন্টের এ ঘটনা প্রকাশের পর সর্বস্তরের জনগণ ফেটে পড়ল। তখন ৬-দফার আন্দোলন তুঙ্গে। ছাত্ররা তাদের ১১ দফার আন্দোলন সংযোজন করল ৬-দফার আন্দোলনের সঙ্গে। ৬৯ সালে অভ্যুত্থান ঘটে গেল।
পাকিস্তানি শাসকদের বিনাশর্তে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হলো। লাখো জনতার মধ্যে প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব ফিরে এলেন। তারা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করলেন। সেই থেকে তিনি বাংলার পরিপূর্ণ বন্ধুত্ব অর্জন করলেন। তার সুদীর্ঘ ত্যাগ তিতীক্ষার কারণে জনগণ যে উপাধিতে ভূষিত করলেন, তা তিনি মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত পালন করে গেছেন।
সুতরাং ৬-দফার ব্যাখ্যায় একথা অত্যুক্তি হবে না, স্বাধীনতার মূল মন্ত্রই ছিল ৬-দফা। ৬-দফার কারণেই গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলনের কারণে, বঙ্গবন্ধু বাঙালির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের সর্ববৃহৎ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। পাকিস্তানের কোনো কোনো শাসক তাকে প্রলুব্ধ করার জন্য আহ্বান করেছিলেন।

তাদের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীত্বের বিনিময়ে ৬-দফার প্রশ্নে আপস করবেন। কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ৬-দফা গণম্যান্ডেট, নির্বাচনের মাধ্যমে সে ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠিত, তাই ৬-দফার প্রশ্নে আপস করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফল যা হওয়ার তাই হলো। ভুট্টো পাকিস্তানে ফিরে গেলেন।
যাওয়ার সময় যে নির্দেশ দিলেন তাই সামরিক শাসক ইয়াহিয়া কার্যকর করল। ২৫ মার্চের কালরাতে শুরু হলো অপারেশন সার্চলাইট। প্রথম রাতেই কয়েক হাজার নিরীহ বাঙালিকে প্রাণ দিতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, পুলিশ, ইপিআর-বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল।
এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলে ৯ মাস। পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ জ্বালিয়ে ছারখার করা হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা পেল না দখলদার বাহিনী। তাদের আত্মসমর্পণ করতে হলো বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর কাছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। মাত্র ২৩ দিন পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন।
২৫ মার্চের কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুকে তারা গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের কারাগারে তাকে ৯ মাস আটক রাখা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমাদের সংবিধানে যে ঘোষণার কথা উল্লেখ আছে এবং সে ঘোষণাভিত্তিক বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের অভিভাবক এখন অনেকে। একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা প্রায়ই বলে থাকেন অতীত নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ কী? বর্তমান ও ভবিষ্যৎই তো সব কিছু। এরা তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ঘটনাবলি, প্রেক্ষাপট, সংগ্রাম-আন্দোলনকে অতীত বলে অগ্রাহ্য করেন। অতীতে এদের কোনো অবস্থান ও অস্তিত্ব ছিল না। তাই তারা অতীতবিমুখ। কিন্তু যে অতীত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল, যে অতীতের ধারাবাহিকতায় আজকের বর্তমানের সৃষ্টি এবং উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, সেই অতীতকে তারা অবজ্ঞার অতল গর্ভে তলিয়ে দিতে চায়।

এখানেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে বিরোধীদের বিরোধ। এ কারণেই তারা শেখ হাসিনাকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না। জাতির জনকের কন্যা হিসেবে যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তিনি পালন করে চলছেন বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এবং জাতিকে ফিরিয়ে এনে যে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছেন, স্বাধীনতার শত্রুরা তা কখনো মেনে নিতে পারে না। এ জন্যই শেখ হাসিনার শাসনামলের ভালো কোনো কিছু তাদের চোখে পড়ে না। তারা শুধু গুম, হত্যা ও আইনশৃঙ্খলার অবস্থাই দেখেন।
আসলে ৬-দফার প্রশ্ন বিশদভাবে আলোচনা করলেই সেদিনের বাস্তবতায় কেন যে বাংলার জনগণ ৬-দফাকে যৌক্তিক বলে গ্রহণ করেছিল তা অনুধাবন করা সম্ভব। ৬-দফা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক মাইলফলক। ৬-দফা আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করতে পারলে রাজনীতিতে যে সফলতা সম্ভব, তা ৬-দফা আন্দোলনই প্রমাণ করে।
অনেককেই আজ বলতে শোনা যায় প্রতয়নে অভিভাবকত্বের কথা। তাদের কথায় মনে হয়। বঙ্গবন্ধু বোধ হয় তাদের পরামর্শ মতো আন্দোলন করেছিলেন। তার বোধশক্তির নিদারুণ অভাব ছিল। ঘটনার প্রভাব কি এ যুক্তি সমর্থন করে? শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ছিল এক, অদ্বিতীয় ও অসাধারণ। তার লক্ষ্য ও ধারণা ছিল স্পষ্ট। তাতে কোনো ঘাটতি ছিল বলে কখনো মনে হয়নি।
আরও পড়ুন:





