ভারতে জাতীয়তাবাদ

ভারতে জাতীয়তাবাদ : এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও জাতীয়তাবাদের চেতনার উদ্ভব হয় ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরোধী শিবির থেকে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শিবিরে যে চেতনার উন্মেষ ঘটে, তাতে একটা বিড়ম্বনা ছিল— ব্রিটিশরা ভারতে ইংরেজি শিক্ষার গোড়াপত্তন করে এবং ইংরেজি শিক্ষার সুবাদেই ভারতীয়রা উদার গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়, আবার এই উদার গণতন্ত্রের অনুভূতিই তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অনুভূতি গড়ে তোলে এবং একসময় তারা ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে। তার মানে এই নয় যে, ভারতীয়দের মধ্যে স্বজাতীয় জাতীয়তাবাদের কোনো অনুভূতি ছিল না।

ভারতে জাতীয়তাবাদ, Mahatma Gandhi, Indian Nationalist
Mahatma Gandhi, Indian Nationalist

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মবাদ ও জাতিগত মিথস্ক্রিয়া এবং পারস্পরিক মেলামেশার যে চিরন্তন যোগটা সুপ্ত ছিল, ইংরেজ শাসনের যাতাকলে পড়ে তাই একদিন জেগে ওঠে এবং ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ৪৭ ভারতে জাতীয়তাবাদ ব্রিটিশ শাসনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। দুশো বছরের শাসনের প্রভাবে এশিয়াতে কিছু ভালো ফলও দেখা দিয়েছিল। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হোক আর রাজনৈতিক প্রভাব তাড়িতই হোক, ব্রিটিশরা তোর। পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থা, করেছে তা ভারতীয়রা অস্বীকার পারেনি।

[ ভারতে জাতীয়তাবাদ ]

উন্নয়নমূলক কাজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, উদার এবং সংগঠিত আইন পদ্ধতি” এবং নতুন ধরনের জনপ্রশাসন এই ি এই বিষয়গুলো ভারতে ব্রিটিশরাই ব্যাপকভাবে সংযোজন করে। বাদে হিসেবে ধরা হলে করে ব্রিটিশদের উদার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল হিসেবেই ভারতে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস জাতীয়তাবাদের পদযাত্রার শুভ সূচনা করে। কংগ্রেস ১৯১৮ সালের পর ভারতের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটি বড় ভূমিকা রাখে।

১৯ তবে কংগ্রেস জন্ম নেওয়ার আগেও কয়েকটি সংগঠন ভারতের জাতীয় স্বার্থ ত্বরান্বিত করার জন্য আন্দোলন করে। ১৮৩৭ সালে প্রথম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ‘জমিদার’ নামের সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। বলা বাহুল্য যে, এ সংগঠনের সব সদস্য ছিল জমিদার কিন্তু সংগঠনের নাম পাল্টে পরে রাখা হয় ‘ল্যান্ডহোল্ডার সোসাইটি’। সংগঠনটি ‘জনগণের সঙ্গে কথা বলত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এবং তা প্রকাশ করত ব্যাপকভাবে।

সিপাহী বিদ্রোহের আগেই আরেকটি সংগঠন গড়ে ওঠে ১৮৪৩ সালে। এর নাম ছিল ব্রিটিশ ভারত সংঘ (সোসাইটি) এ সংগঠন ভারতের শিক্ষিত জনগণের উপর কোনোও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে নিখিল ভারতের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সংগঠনের এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ নামে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর সংগঠনটি তাদের কর্মসূচি থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাদ দেয়।

Indian Nationalism
Indian Nationalism

তবুও ১৮৭০ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল ভারতে সরকার স্বীকৃত একমাত্র রাজনৈতিক দল। ৫২ বাঙালি রাজনৈতিক নেতা শিশির কুমার ঘোষ উনিশ শতকে ‘ভারত লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত লীগ’ জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগাতে সাহায্য করে এবং রাজনৈতিক শিক্ষা অর্জনে গুরুত্ব দেয়। এরাই প্রথমবারের মতো প্রদেশের বাইরে রাজনৈতিক অনুসন্ধান চালায় ভারতে সামাজিক জীবনব্যবস্থার অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে ধর্ম একটি বড় সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়।

একথা বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদের উপলব্ধি আসলে জাতীয়তাবাদীদের মনেই সুপ্তভাবে প্রোথিত ছিল। একই সময়ে ভারতের জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ধর্মটা একটি বড় রকমের বাধা তা-ও প্রমাণ হয়েছিল। উদারহণ দিয়ে বলা যায়, হিন্দু সমাজে বর্ণ সমস্যা ছিল প্রকট, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রভাবে সৃষ্ট বর্ণপ্রথার কারণে প্রায়ই সামাজিক সমন্বয় ভেঙে পড়ার উপক্রম হতো। তবে হিন্দু নেতারা ভারতের জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে জনমনে জাতীয়তাবাদী উপলব্ধি সৃষ্টি করার জন্য ধর্মীয় ভাবধারা ব্যবহার করেছেন।

শুরুতে হিন্দু নেতারা দু’ধরনের ধর্মীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং এখন পর্যন্ত তা বিদ্যমান রয়েছে। এর একটি ছিল রেনেসাঁর পক্ষে বা হিন্দু ঐতিহ্যকে গৌরবান্বিত করে এমন ভাবধারা, এটা হিন্দু সম্প্রদায়গুলোকে পুনরায় একত্রিত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ এই ধারার নেতৃত্বে স্বামী দয়ানন্দ স্বরসতী এবং স্বামী বিবেকানন্দের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই আন্দোলনের ফলে হিন্দু ইতিহাসে একটি নতুন চেতনা এবং পুনর্জাগরণের বোধ জন্ম হয়। এর ফলে হিন্দুদের মধ্যে যে সচেতনতা জেগে ওঠে তার ফলশ্রুতিতে এখন এখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন হয়।

দ্বিতীয় ধারায় ধর্মীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু ধর্মীয় অনাচারকে সংস্কার করে সেখানে একটি প্রগতিশীল ধর্মীয় বোধ সৃষ্টি করার। এই আন্দোলনে তার সঙ্গে ছিলেন, কেশব চন্দ্র সেন এবং আরও অনেকে।৫৫ এই ধারার আন্দোলনের ফলে হিন্দুদের মনের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা গড়ে ওঠে এবং আপনা থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিষয়টি আরও শক্তিশালী রূপ লাভ করে। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদের এই শক্তিশালী উন্মেষের ফলে ভারতে জাতীয়তাবাদের ঐক্যের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়।

Indian Nationalism
Indian Nationalism

হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রদায়গত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মুসলমান এবং শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে। একই সময়ে আরেকটি বিষয় উজ্জ্বল হয়েছিল, ভারতে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি আদর্শগতভাবেই সুগভীরে প্রোথিত ছিল, পাশাপাশি গণতন্ত্র, উদারতা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের চিন্তা এবং ধারণাও ছিল। এই ভাবধারাটি ভারতীয় নেতারা আসলে পশ্চিমাদের কাছেই শিখেছিলেন।

সুতরাং বলা যায়, ভারতে যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে তার ভিত্তি যেমন প্রগতিশীল উদারনৈতিক ছিল, তেমনি ধর্মীয় প্রভাব ছিল। তাতে। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর এর কর্মসূচির ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক স্তরই বিবেচনায় রাখা হয়, যা ভারতে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় গড়ে উঠেছিল। ক্রমে কংগ্রেস-এর কর্মকাণ্ড এবং আনুষ্ঠানিকতায় জাতীয় উপলব্ধি, জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় দাবি, জাতীয় সমস্যাবলীর সংযোজন হতে থাকে। কাজেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস শুধুই ভারতে জাতীয়তাবাদের কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এটা ভারতে জাতীয়তাবাদের রক্ষক এবং এর উন্নয়নের সঙ্গেও জড়িত ছিল।

১৯২০ সালের দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস শান্তিপূর্ণ এবং শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মতামত ও দাবি উত্থাপন করতে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার দাবি দাওয়ার প্রতি সঠিক মনোযোগ না দেওয়ার ফলে সদস্যদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং তারা আন্দোলনের পন্থা অবলম্বন করে। বিশ শতকের প্রথম দু’দশকে কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করে একটি গণ আন্দোলনে রূপ দিয়ে। এই লক্ষ্যে কংগ্রেস জনসাধারণকে তাদের কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করতে শুরু করে।

জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে এই উপলব্ধি ছিল যে, ভারতের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত ও অবহেলিত। কাজেই যৌক্তিক কারণ ছাড়া তাদেরকে আন্দোলনের এই ধারায় আনা সম্ভব নয়। কারণ তাদের মনের ধারা পূর্বকালের প্রভাবেই ভেসে যাচ্ছিল তখনো। বাল গঙ্গাধর তিলক এই সমস্যা সমাধানের পথ বের করলেন। তিনি ভারতীয়দের ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক সচেতনতায় পরিণত করার চেষ্টা করলেন। তিনি গণেশ উৎসব শুরু করেন উনিশ শতকের শেষভাগে এসে, জনগণের মন আন্দোলনের দিকে ফেরানোর জন্য।

পরে গান্ধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক এবং ধারণা ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু অসাবধানতাবশত গান্ধীর এই প্রয়াস মুসলমানদের মনে কংগ্রেস এবং এর কর্মকাণ্ডের প্রতি সংশয়ের জন্ম দেয়। ৫৬ যদিও ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল, তবু বহুবছর মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিসেবে ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের ধর্মীয় অবস্থান ক্রমেই মুসলিম লীগকে আন্দোলনের প্রধান প্রবাহ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে।

মুসলমান নেতারাও ধর্মীয় শর্তাবলির কথা বিবেচনা করতে থাকে। একথা জোর দিয়ে বলা যায়, মুসলমানদের মধ্যে। সাম্প্রদায়িকতা সুদৃঢ় হয় হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে, যা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে ব্যাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু কোনো মতেই একথা বলা যায় না। যে, কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছিল; না একেবারেই তা ছিল না। কিন্তু ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিশেষ করে, যখন হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় দিক থেকে জাতীয়তাবাদের উপলব্ধি বাড়ানোর জন্য যে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয় তখন সেটাই মুসলমানদের মনে সাম্প্রদায়িকতার ধারণা তৈরি করে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আলোচনা শেষ হবে দেশাই আর এ’র কথা দিয়ে। তিনি বলেন, “বিশেষভাবে ভারতীয় হিন্দু এবং সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে অতিমাত্রায় সামাজিক ও ধর্মীয় বিভাজনের ফলে ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের পিছনে একটি অদ্ভুত কার্যকারণ তৈরি হয়।’

Read More:

জাতীয়তাবাদের বিকাশ

জাতীয়তাবাদ

Leave a Comment