জাতীয়তাবাদের বিকাশ

জাতীয়তাবাদের বিকাশ : পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত আধুনিকতাপূর্ব সমাজ পশ্চিমা এবং আধুনিক ভাবধারার জাতীয়তাবাদের প্রভাবের ফলে বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়। আঠার শতকের আগে যখন উত্তর পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় এর যাত্রা শুরু হয়; জাতীয়তাবাদ তখন গোটা পৃথিবীতেই বেশ শক্তিশালীরূপে জায়গা করে নিয়েছে এবং সমসাময়িক ইতিহাসের সুবাদে বিশ শতকের মাঝামাঝি হতে এটি একটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত লাভ করে। একেবারে গোড়া থেকেই জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। উদ্দেশ্য, একেবারে নতুন একটি রাজনৈতিক অস্তিত্ব তৈরি করা নৃতাত্ত্বিক অথবা ভাষাগত আনুগত্য রয়েছে এমন এলাকায় বিস্তার ঘটানো। ২৫

জাতীয়তাবাদের বিকাশ - রাজনীতি [ Politics ]
রাজনীতি [ Politics ]
আমেরিকা এবং ফরাসি বিপ্লবই জাতীয়তাবাদের প্রথমদিকের প্রকাশ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদের মতো জি, পি, গুচ জাতীয়তাবাদকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: “জাতীয়তাবাদ হলো ফরাসি বিপ্লবের সন্তান। ২৬ ল্যাটিন আমেরিকার নতুন দেশসমূহে এর অনুপ্রবেশ নিশ্চিত হওয়ার পর উনিশ শতকে এটি মধ্য ইউরোপে বিস্তারলাভ করে এবং সেখান থেকে একই শতকের শুরুতে এশিয়ার কোনো কোনো অংশে এবং আমেরিকায় বিস্তার লাভ করে এবং বিশ শতকেই অন্যান্য বিপ্লবী ধারায় প্রবাহিত হয়ে জাতীয়তাবাদ একটি সামাজিক বিপ্লবের আন্দোলনে রূপ নেয়।

[ জাতীয়তাবাদের বিকাশ ]

দাবি করে সম-অর্থনীতি, সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ এবং সামাজিকভাবে যারা অধঃপতিত তাদের জীবন মানের উন্নয়ন। জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপ হলেও কয়েকটি রূপান্তরের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়। দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের আন্দোলন ভিন্ন আঙ্গিকে সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ওই সব দেশে প্রথমে গণআন্দোলন হয়েছে এবং পরে তা বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অন্যদিকে, কিছু চিহ্নিত দেশে প্রথমে তারা বুর্জোয়া প্রভাবিত জাতীয়তাবাদে উদ্যোগী হয় এবং পরে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তেমন একটি ব্যাপার— যার মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক। ২৭

অনেকক্ষেত্রে দাবি করা হয়। যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণিই এই জাতি-রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে এবং জাতীয় চিন্তাধারায় এই শ্রেণিই বিশেষ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছিল, কথাটা ঠিক নয়। জনগণের একটি বড় অংশ ছাড়া জাতীয়তাবাদীরা কখনো ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে না। তবে একথা ঠিক যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আপন গতিতেই জাতীয়তাবাদের একটি ধারণা গৃহীত হয় এবং তা স্বচ্ছ হয়ে বেরিয়ে আসে। এটি শুধু রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ছিল না, একেবারে কৃষককুলের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়, কিন্তু সামাজিক শৃংখলাবদ্ধ সমাজবদ্ধ মানুষের বেশির ভাগের মধ্যেই এটি বিস্তৃত।

জাতীয়তাবাদ প্রায়শই, জনগণের অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া বলে মনে হয়। এজন্যই কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটাকে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ মনে হবে।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ তখনই গড়ে উঠতে পারে, যখনই একটি দেশ কোনো অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে অথবা অন্য কোনো জাতির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সমান্তরালেও বেড়ে উঠতে পারে। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ আরও বেশি শক্তিশালী হতে পারে, রাষ্ট্রের, জাতীয়তাবাদ এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের মধ্যে যদি একই সাথে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ওঠে।

ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা কোনো দেশে বুর্জোয়া শ্রেণির উন্মেষ ঘটলে তার অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায়ই গড়ে উঠতে পারে। যে সব সমাজবিজ্ঞানী অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূত্র উদ্ভাবন করেছেন, তাদের অনেকেই প্রায়ই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন।

রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সমান্তরালে বেড়ে ওঠে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। অন্য কথায় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একটি ঘনিষ্ঠ সমান্তরাল গতি রয়েছে। জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদগণ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন। বর্তমানে আর্থিক সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তহীন সংগ্রামেও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের ভূমিকা রয়েছে বিশ্ববাজারে যা রাষ্ট্র ও শান্তির পক্ষে হুমকিস্বরূপ।

সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কেউ অবহেলা করতে পারে না। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এশিয়া এবং আফ্রিকাসহ বহু দেশের উপর কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে এবং সম্ভাব্য সকল পথে শোষণ করেছে। ফলে ঐ সব ঔপনিবেশিক দেশে উপনিবেশবাদ বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে আত্মবিশ্বাসী জনগণের কাছে সাম্রাজ্যবাদ একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। অনেক দেশেই স্বাধীনতার আন্দোলন স্বদেশীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং পাশাপাশি এই আন্দোলনের সঙ্গে সে দেশে জাতীয়তাবাদও ভিত্তিগত রূপ পায়। ৩১

জাতীয়তাবাদের ধারণা বেশি করে বদ্ধমূল হয় তখন, যখন কোনো দেশের জনগণ বুঝতে পারে যে, ক্ষমতাসীন সম্প্রদায় বা শ্রেণি তাদের উপর নির্যাতন ও শোষণ করছে। অতঃপর মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, শোষণকারী স্বজাতীয় অথবা বিজাতীয় শাসকদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালায়। পূর্বেই বলা হয়েছে, আমেরিকায় বিপ্লবকে জাতীয়তাবাদী শক্তির আন্দোলনের অন্যতম উদাহরণ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে।

উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী শক্তির উদ্ভব হয় এবং তারা সংগ্রাম করে ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উপনিবেশবাদের কারণে তারা যে শোষিত হয়েছে তারই প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ হলো, তাদের মধ্যে জেগে ওঠা জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রকৃত অর্থে গণঅভ্যুত্থান ছিল কি না অথবা উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট মঞ্চের দ্বারা চালিত ছিল, সে বিষয়েও মতপার্থক্য দেখা দেয়। তারপরেও জাতীয়তাবাদ একটি বিপ্লবী পথ নির্দেশক, নিজে নিজের পথেই চলে।

এমনকি মার্কস এবং মার্কসবাদী বিপ্লবও এর বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে মূল্যায়ন করতে পারেনি। তারা জাতীয়তাবাদকে বুর্জোয়া শ্রেণি এবং এর বুদ্ধিজীবী শ্রেণির দ্বারা উদ্ভাবিত জনগণের একটি আদর্শ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। আসলে এটা একটি কূটচাল এবং এই কূটচালে অংশগ্রহণ করার মূল উদ্দেশ্য তাদের শ্রেণিস্বার্থকে রক্ষা এবং উন্নয়ন করা।

মার্কস জাতীয়তাবাদকে মধ্যবিত্ত প্রতিক্রিয়ার বৃহৎ ঘটনা বলে উপহাস করেছেন যে, এতে বোনাপার্টের বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, এতে নিম্নমধ্যবিত্ত ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণিকে ব্যবহারের উদ্দেশ্য রয়েছে। তাদের মতে, বুর্জোয়া শ্রেণি জাতীয়তাবাদের ভাষায় কথা বলে। কারণ, তারা দেশে দেশে জাতীয় সরকার গঠন করে জাতিকে উদ্ধার করতে চায় এবং এর ফলে অন্যজাতির বুর্জোয়া শ্রেণির আক্রমণ থেকে তারা মুক্ত থাকে।

ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীর পশ্চিমে ও পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির কারণে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে এবং অনেক ঐতিহাসিক সত্যের গোড়াপত্তন হয়। কোন (Kon) খুব সূক্ষ্মভাবে পশ্চিমের পুরে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। পশ্চিমাদের ছিল রেনেসাঁ এবং পুনর্গঠনের নৈপথ্য। ঐ জাতীয় জাতীয়তাবাদ যুগ্মভাবে এবং খোলামেলা সামাজিক কাঠামোয় গড়ে ওঠে। এটি জাতির যুক্তিসিদ্ধ একটি গোষ্ঠীকে ধারণ করে। এসব দেশে জাতীয়তাবাদ একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বেই বেড়ে ওঠে। এতে যেমন যৌক্তিক কারণ থাকে তেমনি আবেগের অভিব্যক্তিও থাকে।

জাতীয়তাবাদের এই ভিত্তি বিভিন্ন দেশে কিংবা একটি দেশে, বিভিন্ন সময়ের আবর্তনে, পরিবর্তন হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশে ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয় বা বিখ্যাত হয়ে থাকে আবার অন্যান্য দেশে নৃতাত্ত্বিক অথবা ভাষাগত জাতীয়তাবাদ বিশিষ্ট হয়। ৩৪ কোনো নির্দিষ্ট দেশের ক্ষেত্রে উপ-জাতীয়তাবাদ জাতীয়তাবাদে পরিণত হতে পারে, রাষ্ট্রটি যদি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায় তবে। এই প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের কথা এসে যায়।

১৯১৪ সালে রাজতন্ত্রের সম্রাটদের দ্বারা শুরু হওয়া প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে কিছুটা জনগণের চাপে এবং কিছুটা রাজতন্ত্রের দুর্বল ভিত্তির কারণে সৃষ্টি হয় জাতি রাষ্ট্র। একই সময়ে এটি এশিয়াতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। এর অর্ধশতক পরে, পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে জাতীয়তাবাদ একটি প্রভাবশালী শক্তি অর্জন করে এবং ১৯৪৫-১৯৬৫ সালের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তন করে দেয় অনেকখানি যেমনটি ১৮১৫-১৯২০ সালের মধ্যে ইউরোপে ঘটেছিল।

একথা বলা যায় যে, প্রথম দিকে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে জাতীয়তাবাদের সমর্থন ছিল উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণি। সেসব দেশে তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জনগণকে অংশগ্রহণ করাতে পেরেছিল। কিন্তু একথা গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় যে, ঐসব দেশের বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করা অথবা জনগণকে দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল ছিল। জাতীয়তাবাদকে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের পরিমার্জিতরূপ বলা যায়।

কেউ আবার অতিশয়োক্তি করেন যে, জাতীয়তাবাদ আদিম মানুষের মধ্যেই জেগে ওঠে এবং তা অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা হবে স্পষ্টতই ভুল। ভাবাদর্শের ভিত্তিতে আধুনিক জাতীয়তাবাদ একটি উদার আধুনিক মূল্যবোধ গঠন করে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শোষণের হাত থেকে মুক্ত হওয়া, মানবিক মর্যাদা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং এমন অনেক কিছুর ক্ষেত্রেই আধুনিক ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, উপ জাতীয়তা হলো মূলত আবেগজনিত বিস্ময়কর ঘটনা।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ হলো জনগণের একতার ফলে উৎপন্ন শক্তি, মর্যাদা রক্ষার প্রধান হাতিয়ার, স্বাধীনতা অর্জনের শক্তিশালী মনোবল। শুধু তাই নয়, জাতীয়তাবাদ জনগণের মধ্যে তৈরি করে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনেও জাতীয়তাবাদের ভূমিকা অপরিহার্য।

Read More:

জাতীয়তাবাদের ক্রম উন্নতি

জাতীয়তাবাদ

Leave a Comment