জাতীয়তাবাদের ক্রম উন্নতি : একটি দেশের রাজনীতি অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামো ইত্যাদির প্রকৃতি অনুযায়ী সেখানে যে সামাজিক সাংস্কৃতিক উপাদান সৃষ্টি হয় তার উপর ভিত্তি করেই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এজন্যই দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের রূপ এবং এর ক্রমবিকাশ ভিন্নভাবে হয়ে থাকে। জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় যে, কোনো দেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য অথবা অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করেছে তবে তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক নেপথ্য ঘটনা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অনুভূতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বলা হয়, প্রত্যেকটি ছোট জাতি সংগ্রাম করে জন্মগ্রহণ করে এবং সুনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে চলে। ১৮
![জাতীয়তাবাদের ক্রম উন্নতি - জাতীয়তাবাদ [ Nationalism ]](https://politicsgurukul.com/wp-content/uploads/2022/02/Nationalism-জাতীয়তাবাদ-5-300x171.jpg)
[ জাতীয়তাবাদের ক্রম উন্নতি ]
কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, একটি ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে স্থান পায় নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত জাতীয়তাবাদ অথবা দুই বা ততোধিক ভাষার সংঘর্ষের কারণে কিংবা সাবেক ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদের আদলে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের দ্বারা। আধুনিক কালে জাতীয়তাবাদ একটি প্রবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি গোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত; কারণ একটি আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি জাতীয় ভাষা ঐতিহ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাষা (ইউরোপ, ল্যাটিন, এবং পরে ফরাসি) এবং আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলেমিশে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে।
আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনক জ্যাঁ জ্যাক রুশো এবং হার্ডার একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে সংস্কার মুক্ত অথবা আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। জাতীয়তাবাদের ধারণাকে উন্নত করতে তাদের অবদান রয়েছে; দু’জনেই তাদের লেখায় বিভিন্নভাবে জাতীয়তাবাদী সচেতনতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের প্রধান ভাবাদর্শ রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ধারণা সৃষ্টিকারী ছিলেন রুশো।
হার্ডারের কাল্পনিক জাতীয়তাবাদ মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৪০ এবং ১৮৯০-এর দশকে ইউরোপের অনেকগুলো গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ইউরোপের জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়া জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শ জনগণকে এসব অভ্যুত্থানে উদ্বুদ্ধ করে। জাতীয়তাবাদের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সময়ে যে সব আন্দোলন হয় তার সবগুলোই জনগণের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত হয়।
![জাতীয়তাবাদ [ Nationalism ]](https://politicsgurukul.com/wp-content/uploads/2022/02/Nationalism-জাতীয়তাবাদ-3-300x169.jpg)
জনগণ তাদের পছন্দও করে কিন্তু তাদের সকল কর্মকাণ্ড আবর্তিত হতো নিজেদের উন্নয়ন ও স্বার্থ রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় দেশগুলোতে নতুন ধরনের এক আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষ ঘটে, তবে এর কোনো নিজস্ব ধারণা ছিল না। এটি ১৯১৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১৯৪৫ এর পরে জাতীয়তাবাদের সাহচর্যে এই জগাখিচুরি জাতীয়তাবাদ মূলত ইউরোপের কয়েকটি দেশেই বিভিন্ন কাঠামোতে উত্থান ঘটেছিল।
ইতালির ফ্যাসিবাদ এবং জার্মানির নাৎসিবাদ এই ধরনের জাতীয়তাবাদের দুটো উদাহরণ হতে পারে। প্রবল সম্ভাবনার দ্বারা জাতীয়তাবাদ জাতীয় ভাবাদর্শের প্রধান শক্তিরূপে পরিগণিত হয় এবং জাতীয় গঠনের অপরিহার্য উপাদানের ধারণা তৈরি হয়— এর প্রভাব পড়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থার উপর, যা বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের মনে জাতীয়তার অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। ২০১
জাতি ও জাতীয়তাবাদের অর্থ এবং এর অন্তর্নিহিত ভাব উদ্ধার করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ জাতির অপরিহার্য উপাদান বিশ্লেষণ করেন নিরলসভাবে এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক শর্ত যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত জনগণের মধ্যে জাতিসত্তার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে এমন বিষয় নিয়ে। তারা আরও এগিয়ে যান। উল্টোপথে প্রবাহিত সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত জাতীয়তাবাদের কর্মসূচি নিয়েও গবেষণা করার চেষ্টা করেন।
![জাতীয়তাবাদ [ Nationalism ]](https://politicsgurukul.com/wp-content/uploads/2022/02/Nationalism-জাতীয়তাবাদ-4-300x208.jpg)
কার্লটন জে, এইচ, হায়েস বলেন, “কোনো জাতীয়তাই স্বীকৃতি পাবে না, যদি তার স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্ব ভিত্তি দুর্বল থাকে; তবে ভৌগোলিক, জৈবিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপাদানগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘ভাষা’ হচ্ছে প্রধান শক্তি অন্য কথায় বলা যায়, জাতীয়তাবাদ আসলে দ্রুত সফল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক বিস্ময়।
আবার কিছু দেশে জাতীয়তাবাদ তাদের নিজস্বতা হারায় পারিপার্শ্বিক চাপের ফলে। যেমন ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে মিশরে ফারাও জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি ঘটেছিল এবং ১৯৬০-এর দশকে আরব জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। একইভাবে উপ-জাতীয়তাবাদ পুরোদস্তুর জাতীয়তাবাদে উন্নীত হয় যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ঘটনাটি।
ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ মিলে শক্তি বৃদ্ধি করে, ব্রিটিশ ভারতের একাংশের মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই তাদের মধ্যে একসময় রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। ফলে পাকিস্তানের জন্ম হয়।
![রাজনীতি [ Politics ]](https://politicsgurukul.com/wp-content/uploads/2022/02/রাজনীতি-Politics-1-300x169.jpg)
“মূলত মানুষ একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত,
তাদের সৃষ্টিও একই আত্মা থেকে,
দেহের কোনো অংশে যখন ব্যথা হয়,
তখন দেহের অন্যান্য অংশেও তা অনুভূত হয়।”
এরপর তিনি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন মাসিক ‘মুসলিম ন্যাশনাল রিফরমার’। এর এক জায়গায় তিনি বললেন যে, কোনোও জাতিকে ভালোবাসা মানেই তার নিজের বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করা। বিশ শতকে এসে তার উত্তরসূরি স্যার মোহাম্মদ ইকবাল এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারা প্রবল করলেন কিন্তু পরে তা মুসলমান জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়।
অন্যদিকে আবুল কালাম আজাদ তার রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী হিসেবে কিন্তু ১৯২০ সালে তিনি প্রগতিবাদী এবং ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদের ধারায় যোগদান করলেন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক স্লাইডার সঠিক বিশ্লেষণ করেছেন, “জাতীয়তাবাদ এত বেশি আঙ্গিকে আবর্তিত হয়েছে এবং এত বেশি মানুষের কর্মকাণ্ডে এটি গৃহীত হয়েছে যে, এখন জাতীয়তাবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব এবং করলেও তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।”২৪
আরও পড়ুন:
