৭ জুন বোনা হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ – মহিউদ্দিন আহমদ

৭ জুন বোনা হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ – মহিউদ্দিন আহমদ : একটি সমাজের বা দেশের পরিক্রমায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাল বা সময় থাকে। আমরা অনেক সময় আবেগ দিয়ে বলি ‘দিনলিপির লাল তারিখ’। তো সে রকম একটি দিন হলো ৭ জুন ১৯৬৬ সালের এই দিনে সারা দেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) হরতাল হয়েছিল।

৭ জুন বোনা হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ - মহিউদ্দিন আহমদ

এ দেশে তো নানা ছুতানাতায় হরতাল ডাকা হয়। কোনোটা পুরোপুরি সফল হয়। কোনোটা আংশিকভাবে হয়। কোনোটা একেবারেই ফ্লপ করে। এ দেশে কতবার যে হরতাল ডাকা হয়েছে, তার সংখ্যা বলা যাবে না। তবে ছেষট্টির ৭ জুনের হরতাল ছিল অনন্য। জনসমর্থন না থাকলে এমন হয় না।

[ ৭ জুন বোনা হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ – মহিউদ্দিন আহমদ ]

৭ জুনের হরতাল ছিল মূলত দুটি দাবি সামনে রেখে। এক. শেখ মুজিবের মুক্তি এবং দুই. ছয় দফা কর্মসূচি। ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আগ্লক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন। পাকিস্তান জান্তা এটা ভালোভাবে নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগের ওপর খড়্গ নেমে আসে। নেতা-কর্মীরা একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকেন।

শেখ মুজিব তখন দলের নবনির্বাচিত সভাপতি। তিনি ছয় দফার প্রচারে দেশের আনাচেকানাচে যাচ্ছেন, জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। এক জেলায় বক্তৃতায় দিয়ে ফেরার পথে মামলা হয়। তিনি গ্রেপ্তার হন। জামিন নিয়ে আরেক জেলায় যান। সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার পর আবার মামলা, আবার গ্রেপ্তার। এভাবেই চলতে থাকে। অবশেষে ৮ মে নারায়ণগঞ্জে বক্তৃতা দেওয়ার পর তাঁকে ডিফেন্স অব পাকিস্তান অ্যাক্টে (পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন) গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়। এ আইনে বন্দি হলে জামিন হয় না।

এখন ছয় দফা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যাক। শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা একসময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ করতেন। তাদের স্লোগান ছিল ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। পাকিস্তান হলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মাস না পেরোতেই তাঁদের হুঁশ হলো, তাঁরা ঠকেছেন। করাচিভিত্তিক মুসলিম লীগের কর্তৃত্ববাদী আচরণে তাঁরা হতাশ হলেন। তখন থেকেই তাঁদের নড়াচড়া।

এই প্রদেশের সরকারি নাম ছিল ইস্ট বেঙ্গল বা পূর্ববঙ্গ। ভারত ভাগ হওয়ার সময় ধর্মীয় শরিকানা বিবাদে বঙ্গ প্রদেশও ভাগ হয়। পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে যায়, পশ্চিমবঙ্গ ভারতে থাকে। কিন্তু এ দেশের রাজনীতিসচেতন তরুণদের কাছে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি একটি ক্রেজ। বঙ্গ-টঙ্গ আবার কী! ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান জারি হলে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি প্রদেশের উল্লেখ করা হয়। একটি পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানে চারটি প্রদেশ ছিল: পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। ওই চারটি প্রদেশ একীভূত হয়ে হলো পশ্চিম পাকিস্তান ।

কিন্তু পূর্ববঙ্গের অগ্রগামী তরুণেরা আগে থেকেই নিজেদের ‘বঙ্গ’ পরিচয় বিসর্জন দিয়ে ‘পাকিস্তান’ পরিচয়টাকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছিলেন, স্বেচ্ছায়। কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এভাবেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৈরি হলো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠন করা হলো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তে বামপন্থি তরুণেরা ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল তৈরি করলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। পাকিস্তান নিয়ে মোহমুক্তি ঘটেছে আরও পরে, ধীরে ধীরে।

পূর্ববঙ্গের সার্বভৌম অবস্থানের একটি রূপকল্পের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৪০ সালের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে, ২৩-২৪ মার্চ। ওই বৈঠকে গৃহীত তিনটি সার্বভৌম অঞ্চল নিয়ে একটি সর্বভারতীয় কনফেডারেশনের প্রস্তাব ছিল। স্যার জাফরুল্লাহ খানের লেখা প্রস্তাবটি পাঠ করেছিলেন অভিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগের নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের এক কনভেনশনে জিন্নাহর পরামর্শে অবিভক্ত বাংলার তখনকার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী লাহোর প্রস্তাবের কয়েকটি শব্দ বদলে দিয়ে এক পাকিস্তানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

মুসলিম লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন ও জয় ছিল ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন। ওই নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, নেজামে ইসলামী এবং খেলাফতে রাব্বানী পার্টি একটি ‘যুক্তফ্রন্ট’ তৈরি করে।

বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা-8আওয়ামী লীগের একটি ৪২ দফা কর্মসূচি ছিল। এটাকে কাটছাঁট করে। যুক্তফ্রন্টের জন্ম ২১ দফা কর্মসূচির খসড়া তৈরি করেন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহসভাপতি আবুল মনসুর আহমদ। ২১ দফার ১৯ নম্বর দফায় বলা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হবে। এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় পূর্ববাংলার সরকারের হাতে আনা হবে… পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে। এই দাবি উপেক্ষিত হয়।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো ছিল কেউ ঝিমিয়ে, কেউ অবসরে। ১৯৬৪ সালের ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব প্রায় একক নেতৃত্বে দলের পুনরুজ্জীবন ঘটান। ইতিমধ্যে তিনি ‘পূর্ববঙ্গ’ স্বাধীন করার ব্যাপারে মনস্থির করে। ফেলেছেন। সাহায্যের আশায় গোপনে ত্রিপুরা গেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর এই মিশন তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যাপারে তিনি আরও মরিয়া হয়ে ওঠেন। তার ফলে একপর্যায়ে জন্ম নিল ছয় দফা কর্মসূচি।

১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে লাহোরে অনুষ্ঠেয় বিরোধী দলগুলোর একটি সভায় যোগ দিতে গিয়ে আগের দিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি হয়। দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। সাবজেক্ট কমিটির এটি বিবেচনা করেতে রাজি না হওয়ায় তিনি ওয়াকআউট করে লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে তার কর্মসূচি তুলে ধরেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি এটি প্রথমে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে তোলেননি। তিনি জানতেন, দলের রক্ষণশীল নেতারা এটা সহজে মেনে নেবেন না। ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ধানমণ্ডির বাসায় ওয়ার্কিং কমিটির এক মিটিংয়ে তিনি এটি প্রায় নিজের একক চেষ্টায় পাস করিয়ে নেন।

ছয় দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম জনসভা করেন চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬। তাঁকে জোর সমর্থন দেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ। ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকা হয় ১৮-১৯ মার্চ কাউন্সিল উপলক্ষে ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ শেখ মুজিবের নাম আমাদের বাঁচার দাবি- ছয় দফা কর্মসূচি শিরোনামে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় এক ফর্মার একটা পুস্তিকা ছাপিয়ে বিলি করা হয়।

ওই কাউন্সিল মিটিংয়ে শেখ মুজিবকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদেক সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগের কমিটির পুনর্বিন্যাস হয়। ২০ মার্চ পল্টনের জনসভায় ঢাকায় প্রকাশ্যে ছয় দফার পক্ষে প্রথম ভাষণ দেন শেখ মুজিব। তারপরই তিনি এবং তাঁর দল সরকারের তোপের মুখে পড়ে। তারা একে একে গ্রেপ্তার হন।

৭ জুন ঢাকার হরতালে প্রথমবারের মতো শ্রমিকেরা আওয়ামী লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁও এলাকায় পিকেটারদের ওপর গুলি হয়। ওই দিন মোট ১০ জন শহিদ হন। পরে হাসপাতালে আরেকজন মারা যান। ছয় দফার জন্য বুকের রক্ত প্রথম যাঁরা ঢেলে দেন, তাঁরা সবাই ছিলেন শ্রমিক আর অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন প্রধানত ছাত্রলীগের তরুণেরা ।

ছয় দফা ছিল একটি কনফেডারেশনের ফর্মুলা, যা পাকিস্তানিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এটিই চার বছরের মাথায় এক দফায় রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একটা বড় রকমের বাঁকবদল হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ৭ জুনে। বলা যায়, ওই দিন স্বাধীনতার বীজটি বোনা হয় ।

আরও পড়ুন:

৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস –  সিরাজ উদ্দিন আহমেদ

Leave a Comment