Site icon Politics Gurukul [ রাজনীতি গুরুকুল ] GDCN

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় এবং বীরত্বপূর্ণ দিন হিসেবে পরিচিত। এই দিনটি শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনের স্মারক নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি মোড় পরিবর্তনের সূচনা ছিল। পাকিস্তানের শাসনামলে বাঙালি জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অধিকার রক্ষার লড়াই এই আন্দোলনকে আরও প্রগাঢ় করে তুলেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির এই আন্দোলন একটি স্বাধীন দেশের দাবিকে জাগিয়ে তোলে, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়।

২১ ফেব্রুয়ারি এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট

রাজনৈতিক পটভূমি

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র দুটি ভিন্ন অঞ্চল নিয়ে গঠিত—পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ ছিল বাংলাভাষী, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে পুরো দেশের রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা নেয়।

এই সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়, কারণ বাঙালিরা বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং আবেগ পোষণ করত। তারা নিজেদের ভাষার অধিকার হারাতে চায়নি এবং এই সিদ্ধান্তকে তাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছিল। সেখান থেকেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের মূল সূত্রপাত।

আন্দোলনের সূত্রপাত

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন এবং একটি বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো আওয়াজ তোলেন।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে ঢাকায় বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্ন মিছিল ও সভা আয়োজন করে। আন্দোলনটি ক্রমশ বড় আকার ধারণ করে এবং তাতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সমর্থন বাড়তে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আন্দোলন দমনের চেষ্টা করা হলেও বাঙালি জাতি তাদের দাবি থেকে সরে আসেনি।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা

১৯৫২ সালের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ আবারও বাড়তে শুরু করে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ছাত্র সংগঠনগুলো এবং রাজনৈতিক দলগুলো একত্র হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দাবির পক্ষে সাধারণ ধর্মঘট পালনের দিন হিসেবে ঘোষণা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২১ ফেব্রুয়ারি একটি মিছিল বের করার পরিকল্পনা করে। তবে ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে, যার ফলে কোনো রকম সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও শিক্ষার্থীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং জনতা মিছিল বের করে এবং সেই সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে।

পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর গুলি চালায়। এ সময় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন শহীদ হন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন চরমে পৌঁছে যায় এবং সমগ্র জাতি এক হয়ে ওঠে।

২১ ফেব্রুয়ারির পরবর্তী প্রভাব

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির এই ত্যাগ এবং বীরত্ব বাঙালি জাতিকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে। ভাষার প্রশ্ন থেকে শুরু হলেও, এই আন্দোলন একটি বৃহত্তর স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। বাঙালিরা বুঝতে পারে যে তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজন।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করে এবং একের পর এক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ভাষার অধিকার আদায়ের পরপরই ১৯৬০-এর দশকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

১৯৫২ সালের এই দিনটি কেবলমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নয়, এটি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে। এটি সারা বিশ্বে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উদযাপনের দিন হিসেবে পালিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার অধিকার অর্জনের দিন নয়, এটি ছিল একটি জাতির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবির সূচনা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করে এবং পরবর্তী সময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়। শহীদদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই ইতিহাস জাতির জন্য চিরকালীন গৌরবের।

আরও পড়ুন:

Exit mobile version