Site icon Politics Gurukul [ রাজনীতি গুরুকুল ] GDCN

বাঙালির মুক্তিসনদের বঙ্গবন্ধু – শামসুজ্জামান খান

বাঙালির মুক্তিসনদের বঙ্গবন্ধু - শামসুজ্জামান খান

বাঙালির মুক্তিসনদের বঙ্গবন্ধু – শামসুজ্জামান খান : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পকালের মধ্যেই দেশের মূল নেতৃত্ব পশ্চিম অংশের নেতাদের দখলে চলে যায়। তারা হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী। প্রথমেই তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে, সেই সঙ্গে শুরু হয় অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পূর্ববাংলার রাজনীতি থেকে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট উৎখাত করায় নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরতন্ত্র নানা কূটকৌশলে তাকে নস্যাৎ করে ৯৫৬ সালে তরুণ জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি রাজনীতির শঠতা ও বৈষম্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে দলের পক্ষ থেকে খসড়া সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে এবং সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

[ বাঙালির মুক্তিসনদের বঙ্গবন্ধু – শামসুজ্জামান খান ]

১৯৫৬-৫৭ সালে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান সরকার একটি প্ল্যানিং বোর্ড গঠন করে। এর মধ্যে ছিলেন এ এস এ হুসেন, এম এন হুদা ও অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. মুশারফ হোসেন। প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক এটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রথম প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রাক্-ইতিহাস হিসেবে এই প্রাথমিক প্রয়াসটি উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর এই বোর্ড বাতিল করে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে একটি পরিকল্পনা বিভাগ গঠন করা হয় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে চিন্তাভাবনা করেই তিনি কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অগ্রসর হয়েছেন।

১৯৬৬ সালে দেওয়া তাঁর ৬-দফার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা আদায়ের কর্মপকিল্পনা তৈরির জন্য যে প্ল্যানিং বোর্ড তিনি করেছিলেন, সামরিক সরকার তা বাতিল করে দেওয়ায় সুচিন্তিত ও তীব্র কর্মসূচির মাধ্যমে তার আরও রূপান্তর ঘটান। সেটিই ৬-দফা কর্মসূচি।

আগের ঐতিহাসিক দুটি পরিকল্পনার কিছু উপাদান তিনি এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৪৬ সালে ভারতভাগের প্রাক্কালে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় ভারতের সম্ভাব্য ফেডারেল সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় রেখে বাকি মন্ত্রণালয় অঙ্গরাজ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৯ নম্বর দফাতেও প্রায় এমনই ব্যবস্থা ছিল। তাই ৬-দফাকে অবাস্বব বলার সুযোগ তিনি রাখেননি। তবে পাকিস্তানি শাসকেরা বুঝে গিয়েছিলেন এটি শুধু পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা নয়, পাকিস্তানেরও মরণশেল।

ছয় দফার প্রণেতা কে, এই প্রশ্নে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম তাঁর বই মেকিং অব আ নেশন, বাংলাদেশ : অ্যান ইকোনমিস্টস টেল-এ বলেছেন, ‘শেখ মুজিবই বিষয়গুলির সাবলীল ও সুসংবদ্ধ প্রকাশ ঘটিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে তা ভাষায় রূপ দিতে বলেন, এটাই ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় । ঐতিহাসিক ৬-দফার প্রণেতা তাই শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬-দফা পেশ করেন। কিন্তু সম্মেলনে আলোচনার জন্য সেটি গৃহীত হয়নি। ফলে যৌথ সম্মেলন বর্জন করে ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাঙালির মুক্তিসনদ আখ্যায়িত করে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় এটি মোকাবিলার হুংকার দেন। পূর্ব বাংলায়ও মাওলানা ভাসানী ও বামপন্থীরাও ৬-দফার সমালোচনা করতে থাকেন ।

১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে জনমত সৃষ্টির জন্য ৬-দফার পক্ষে সারা দেশ সফর শুরু করেন। গ্রামবাংলার মানুষ ৬-দফাকে বিপুল সমর্থন দিতে শুরু করে। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আইয়ুব খানের পূর্ব পাকিস্তানি গভর্নর মোনায়েম খান বঙ্গবন্ধুকে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গ্রেপ্তার করতে থাকেন। তিন মাসে তিনি আটবার গ্রেপ্তার হন।

৮ মে নারায়ণগঞ্জে পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৭ জুন শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্পএলাকায় ১১ জন শ্রমিক শহিদ হন। এ ঘটনার তাৎপর্য ভিন্নমাত্রিক।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতার ডাকে শ্রমিকদের আত্মোৎসর্গের ফলে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সর্বজনীনতা লাভ করে। তাঁর অভিষেক ঘটে অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা হিসেবে । আর তাঁর ৬-দফা হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার জনগণের বাঁচার দাবি বা মুক্তিসনদ ।

উৎস: প্রথম আলো, ০৭ জুন ২০২০

আরও পড়ুন:

Exit mobile version