পাকিস্তানের উন্মেষ [ The rise of Pakistan ] পাকিস্থান সৃষ্টির পেক্ষাপট এবং পাকিস্তানের উন্মেষ নিয় বিস্তারিত গবেষনা করছেন নেহাল করিম। সেখান থেকেই তথ্য উপাত্ত নিয়ে ক্রমান্বয়ে দেখানো হলো পাকিস্তানের সৃষ্টি। নেহাল করিমের দেয়া দেয়া গবেষনা রেফারেন্সগুলোও উল্লেখ করা হলো।
পূর্ব কথন:
পরাধীন ভারত ছিল অবিভক্ত কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটো রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারায় বেড়ে ওঠা দুটো জাতি শুধু ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে এক হয়ে পাকিস্তান নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের উন্মেষ ঘটায়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এই নতুন রাষ্ট্রের দুটো অংশ। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম একটি বড় সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা। এই পরিবর্তনে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলাম ভারতবর্ষে নতুন ধর্ম। খ্রিস্টান ধর্মের মতো এটিও বাইরে থেকে এসেছে। এখানে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন হয় মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে। মুসলমানরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসতে শুরু করে খলিফা ওমরের (৬৩৪-৬৪৪) শাসনকাল থেকে। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে আরবের বণিকেরা ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে নৌ-পথে তাদের বাণিজ্যিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে এসব আরব বণিকদের অনেকেই পশ্চিম ভারতের, বিশেষ করে মাদ্রাজের স্থানীয় রাজাদের সুনজরে পড়ে।
তাদের অনেকেরই ভাগ্য পরিবর্তনের প্রধান অবলম্বন ছিল নৌ-বাণিজ্য। সুযোগ বুঝে এসব আরব বণিকদের অনেকেই তখন সেখানে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। তাদের উত্তর পুরুষ এবং তাদের দ্বারা ধর্মান্তরিত লোকদের বংশধর এখনও মালাবা (Malabar) উপকূলে বাস করছে। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এই কয়েক শতক ধরে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলমান যোদ্ধারা সশস্ত্র আক্রমণ চালায় ভারতে কয়েক শতক ধরে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলমান যোদ্ধারা সশস্ত্র আক্রমণ চালায় ভারতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
এর মধ্যে মুহম্মদ ঘুরীর ক্রীতদাস কুতুব উদ্দীন আইবেকই সফল হোন এবং ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। কুতুব উদ্দীন আইবেক এবং তার বংশধর ১২০৮ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এতদঞ্চলে শাসনকার্য অব্যাহত রাখেন। কুতুব উদ্দীন আইবেক ক্রীতদাস ছিলেন বিধায় (যদিও এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে) তার বংশ দাসবংশ নামে পরিচিত ছিল। তের শতকের শেষ দশকে এসে এই দাসবংশের শাসন ব্যবস্থা খানিকটা ম্লান হয়ে আসলে খিলজী বংশ (১২৯০-১৩২০ খ্রিস্টাব্দ), তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১২ খ্রিস্টাব্দ), সাঈদ বংশ (১৪১৪-১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ), এবং লোদী বংশ (১৪৫১-১৫৬২ খ্রিস্টাব্দ) কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষ শাসন করে।
১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ ও পরবর্তী পরিস্থিতি
সাম্রাজ্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে এসে ভারতে মুসলমান শাসন একটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেও ভারতে মুসলমান শাসনের ধারাবাহিকতা পূর্ণমাত্রায় বজায় ছিল। ব্রিটিশরা ভারতে এসে মুঘল শাসনের পতন ঘটায়। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে টিকে থাকার জন্য কৌশলগতভাবে কয়েকটি ছোটখাট রাজ্যও দখল করে নেয় তারা। তাই বলে ভারতে ব্রিটিশদের বিচরণ নির্বিঘ্ন ছিল না। কারণ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশদের গড়ে তোলা ভিতে একটি প্রচণ্ড আঘাত করে।
অপ্রত্যাশিত এই বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশদের আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া বোধের গোড়ায় একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয় এবং তারা জেগেও ওঠে। খানিকটা সচেতন হয়, ভাবতে বসে ভারতীয়দের নিয়ে। কারণ, এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশদের প্রতি ভারতীয় জনগণের মনে জমে থাকা চাপা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে ভারতের হিন্দু মুসলমান দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
ব্রিটিশরা এই বিদ্রোহ তাদের ইতিহাসে শুধু ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বলে উল্লেখ করলেও আধুনিক মুসলমান এবং হিন্দু ঐতিহাসিকদের মতে এটি ছিল ‘স্বাধীনতার জন্য প্রথম যুদ্ধ’ (সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পর মার্কস ও এঙ্গেলস যে মন্তব্য করেছিলেন, মনে করা হয় ধারণাটি সেখান থেকে ধার নেওয়া) “মত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সিপাহী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম বীজ রোপিত হয়। এর মাধ্যমেই ভারতীয়রা যে কতটা অসহায় এবং অধঃপতিত তা ভেবে দেখার প্রয়াস পায়। এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা তাদের জাতীয় সংহতির তীব্র প্রয়োজন অনুভব করে। সুতরাং সিপাহী বিদ্রোহকে শুধু ভারতীয় সিপাইদের বিদ্রোহ বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহের পরের বছর আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে; এটি ছিল ‘নীল বিদ্রোহ’। নীল বিদ্রোহ হয়েছিল ১৮৫৯ সালে। ইউরোপের ভূস্বামীরা বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের উপর নীল চাষ বাধ্যতামূলক করে। ফলশ্রুতিতে কৃষকদের মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ প্রবল হতে থাকে। নীল বিদ্রোহ আসলে কৃষকদের উপর জুলুমের একটি প্রতিবাদ।
কৃষকরা প্রথমে তাদের ভূস্বামীদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে এবং পরে তারা নীল চাষে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়। এতে ইউরোপীয় ভূস্বামীদের স্বার্থসিদ্ধির পথ রোধ হয় অনেকখানি। নীল বিদ্রোহও সফল হয়নি। এ রকম একটি আন্দোলনে গিয়ে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়। নীল চাষিদের এই দাঙ্গা ও পরে ব্রিটিশ স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের মুখে স্তিমিত হয়ে যাওয়া ‘নীল বিদ্রোহ’ মুসলমানদের মনে একটি গভীর ক্ষতের সৃষ্টি তরে এবং তা বাংলা নাটকে, কবিতায় সর্বোপরি ইতিহাসে মূর্ত হয়ে ওঠে।
এদিকে মুসলমানদের দুর্দশা কমিয়ে আনার জন্য তখন স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নওয়াব আবদুল লতিফ, বিচারপতি আমীর আলী প্রমুখ রাজনীতি অঙ্গনের পুরাভাগে এসে মুসলিম রেনেসাঁর ডাক দেন। মুসলিম রেনেসাঁ কর্মসূচির অংশ হিসেবে নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮৬০ সালে কলকাতা মুসলিম সাহিত্য সংঘ ( Mohammedan Literary Society ) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সৈয়দ আমীর আলী শুরু থেকেই মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জনে দায়িত্বশীল ছিলেন।
১৮৭৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কেন্দ্রীয় জাতীয় মুসলিম সমিতি (Central National Mohammedan Association)। এ সমিতির কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তিনি মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এবং জাতি হিসেবে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে উৎসাহ দেন। এদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান তাঁর চিন্তা-চেতনা একটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আলীগড় মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ (এটি পরে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয় এবং মুসলিম জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু রূপে পরিগণিত হয়)।
উল্লেখ্য, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সময় ভারতের উত্তরাঞ্চলের মুসলমানরাই মুসলিম সমাজ পুনর্গঠনে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর আলীগড় কলেজের একজন তরুণ গ্রাজুয়েট নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে আসেন। রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন এই তরুণ নেতার প্রচেষ্টায় অচিরেই এই সংগ্রাম ‘আলীগড় আন্দোলনে রূপ নেয়। তাঁর নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন যখন উত্তরণের পথে তখন তিনি মুসলমানদের জন্য একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
এরই ফলশ্রুতিতে আলীগড় কলেজ থেকে বেরিয়ে আসা রাজনৈতিক শক্তির সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুসলিম লীগ’। মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, মুসলিম লীগ শুধু মুসলমানদের সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সিপাহী বিদ্রোহোত্তর ভারতে সামাজিক পরিবর্তন
সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতীয় জনগণের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বড় ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ভারতের সামাজিক অবকাঠামো, রাজনৈতিক অবস্থা সর্বোপরি ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা কী রকম হবে তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ব্রিটিশ সরকার পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে দেওয়া ভারতের শাসন ক্ষমতা রোহিত করে ১৮৫৮ সালে একটি নতুন আইন পাশ করে এবং ক্ষমতা সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে নেয়।
সিপাহী বিদ্রোহের পরেই ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, ব্রিটিশ শাসক এবং ভারতের জনগণের মধ্যে একটি বড় রাজনৈতিক ব্যবধান রয়েছে। এই অনুধাবন ব্রিটিশ প্রশাসনে ভারতের জন্য একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণ এবং তাদের মধ্যকার ব্যবধান ঘুচিয়ে আনার জন্য একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন (Elite) একটি শ্রেণি গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয়।
এই শ্রেণি বাস্তবে রাজআজ্ঞা মোতাবেক চলবে এবং তাদের প্রধান কাজ হবে ভারতীয় জনগণ এবং ব্রিটিশ সরকারের মাঝে অবস্থান নিয়ে প্রশাসনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করা এবং ব্রিটিশ সরকারের তথাকথিত ইতিবাচক দিকগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা। এসব উদ্দেশ্য সামনে নিয়েই ব্রিটিশ সরকার ভারত উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এগুলোর মধ্যে দুটো বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ : প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজির দ্রুত সংযোজন, এবং দ্বিতীয়ত, ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন। উল্লেখ্য যে, ১৮৩৭ সালে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে ভারতের আদালতি ভাষা করা হয় এবং ১৮৫৩ সালে রেলপথ চালু করার মধ্য দিয়ে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়।
উপরোল্লিখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতে একটি আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এর মাধ্যমে ভারতীয়রা বাস্তবে পাশ্চাত্যের উদার গণতান্ত্রিক (তথাকথিত) চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে অপেক্ষাকৃত প্রজ্ঞাবান ঐসব ভারতীয়দের অনেকেই ব্রিটিশ রাজআজ্ঞা হয়ে শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ প্রশাসনের কর্মচারী হয়ে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের ভিত পাকা করার কাজেও সহায়তা করে; যেমনটি ব্রিটিশদের পরিকল্পনা ছিল।
যাহোক, আধুনিক পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষেশিল্পকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় নতুন অনেক শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়। একদিকে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে, অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষার পরিবর্তন হয়– এই দুইয়ের প্রভাবে ভারতের শহরাঞ্চলে একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই শিক্ষিত শ্রেণি সরকারের প্রতি তাদের মনোভাব প্রকাশ এবং শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নিজেদের দাবি-দাওয়া উপস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে— এটিই ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা
শিক্ষিত জনগণ মিলিত হয়ে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন তৈরি করে নাম দেয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন নিয়েই ১৮৮৫ সালে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোগ গ্রহণ করেন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম (Allan Octavian Hume) কংগ্রেস ভারতীয় সমাজ পুনর্গঠনে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে মূলত এ রকম চিন্তা করেই হিউম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
ব্রিটিশ সরকারের অনেক প্রতিনিধি ভাইসরয় লর্ড ডাফারিনও (Lord Dufferin) কংগ্রেসকে উৎসাহিত করে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন যে, কার্যক্ষেত্রে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। আর এ কারণেই কংগ্রেস শুরু থেকেই একই সময়ে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করে। একদিকে কংগ্রেস নিজেকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করতে তৎপর থাকে, অন্যদিকে সংসদে তাদের ভূমিকা জোরদার এবং প্রশাসনে ভারতীয়দের সহযোগিতা বৃদ্ধির সুযোগ নিশ্চিত করার চেষ্টা চালায়।
যাহোক, কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রথম বিশজন সভাপতির চারজনই ছিলেন ব্রিটিশ। স্যার সৈয়দ আহমদ খান কংগ্রেসের বিরোধিতা করেন। তাঁর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুসলমান কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেয়।
কংগ্রেসের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় মুম্বাইতে। প্রথমে এই অনুষ্ঠানের কথা হয়েছিল ভারতের পুনায়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অনেক সুবিদিত নেতার অংশগ্রহণে কংগ্রেসের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের সূচনালগ্ন থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত যেসব উদার রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী কংগ্রেসে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, পরে তারাই ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পুরাভাগে অংশ নেন।
এই নেতৃত্ব এসেছিল ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উমেষ চন্দ্র ব্যানার্জি (W. C. Banerjee), আনন্দ মোহন বোস (Ananda Mohan Bose), এ, সি, মজুমদার (A. C. Majumder), রাস বিহারী ঘোষ (Rash Bihari Ghose), সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি (Surendra Nath Banerjec), আর, সি, দত্ত (R.C. Dutt), আসেন বাংলা থেকে। মুম্বাই থেকে আসেন দাদাভাই নওরোজী (Dadabhai Naorozi), ফিরোজশাহ মেহতা (Ferojshah Mehta), বদরুদ্দীন তাইবজী (Badaruddin Tyabaji), অপ্তে (Apate), আগারকার (Agarkar), তিলং (Tilang), রানাদে (Ranade), গোপালকৃষ্ণ গোখলে (Gopal Krishna Gokhle), ডি, ই, ওয়াচা (D. E. Waccha), মালবারি (malabari) এবং চন্দ্রভারকট (Chadavarkar)।
পি, আর, নাইডু (P. R. Naidu), সুভ্রামানিয়া আইয়ার (Subramannya Aiyer), আনন্দ চরলু ( Ananda Chrlu), এবং ভিরাগাভ চারিয়ার (Virraghava Charier) এরা সবাই আসেন চেন্নাই থেকে। আরও ছিলেন কেশব পিল্লাই (Keshav Pillai), পণ্ডিত মালাভিয়া (Pandit Malavia) এবং পণ্ডিত ধর (Pandit Dhar)। উদারন্থি ইংরেজ হিউম (Hume), উইডার বার্ন (Wedder Burn) এবং হেনরি কটন (Henry Cottan), কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, এর উন্নয়ন এবং সর্বোপরি এ সংগঠনের এগিয়ে চলার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এর মধ্যে দিয়েই ভারতে নতুন নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটে।
অবশ্য তাদের অনেককেই ব্রিটিশ ছাঁচে গড়া বলে মনে করা হতো। কিন্তু বাস্তবে তারা উপমহাদেশেরই জনগণের প্রতিনিধি হয়ে তাদের উন্নয়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তবে একথাও সত্য যে, কংগ্রেস ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের প্রতিকৃতিতে মিশ্রিত একটি রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। তা সত্ত্বেও জাতির প্রয়োজনে কংগ্রেস সচল ভূমিকা পালন করেছে। ১২
বঙ্গ বিভাগ ও বিরোধী আন্দোলন
বাংলায় মুসলমান রাজনৈতিক গঠনমূলক পর্যায়ের উত্তরণ ঘটে বিশ শতকের গোড়ার দিকে। এ সময়ে বাংলার রাজনীতিতে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে— প্রথমত, ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের সিদ্ধান্ত দেন লর্ড কার্জন; এবং দ্বিতীয়ত, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের গঠন। শতাব্দীকাল ধরে বিহার উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে গঠিত ‘বঙ্গদেশ’ ব্রিটিশ সরকারের প্রাদেশিক শাসনকর্তা শাসন করে আসছিল। কিন্তু ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে হঠাৎ করেই লর্ড কার্জন ঘোষণা দিলেন যে, বঙ্গদেশ দুই ভাগে বিভক্ত হবে।
পশ্চিমে থাকবে হিন্দু আর পূর্বাঞ্চল হবে মুসলমানদের আবাসভূমি। বঙ্গ বিভাগের সপক্ষে লর্ড কার্জন তথা ব্রিটিশ সরকার যুক্তি দাঁড় করাল, বঙ্গদেশ এত বড় যে, একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার পক্ষে সুদক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা কষ্টসাধ্য এবং প্রায় অসম্ভব। প্রশাসনিক সুবিধাদির ধোঁয়া তুলে কার্জন তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেও বাস্তবে বঙ্গবিভাগ রাজনৈতিক যুক্তিতাড়িত। কারণ বঙ্গ বিভাগ শুধু যে ভৌগোলিক পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ছিল, তা নয় বরং এর পিছনে ভারতে হিন্দু মুসলমানের মিলিত শক্তিকে ভেঙে ফেলার সূক্ষ্ম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল।
১০ উচ্চবর্ণের হিন্দু ভদ্রলোকদের (শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু) তরফ থেকেই বঙ্গ বিভাগের বিরোধিতা করা হয়। নির্দিষ্ট বাঙালি হিন্দুশ্রেণির তরফ থেকে বঙ্গ বিভাগের বিরোধিতার কারণ খানিকটা হলেও ব্যক্তিগত ছিল। কারণ, পশ্চিমে থাকা অনেক হিন্দু জমিদারের ভূ-সম্পত্তি ছিল পূর্ববঙ্গে এবং সেখান থেকে সংগৃহীত করের উপর নির্ভর করেই তারা কলকাতার স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনের প্রয়াস পেতেন। কলকাতার আইনজীবীরাও বঙ্গ বিভাগের বিরোধিতা করলেন। কারণ, তারাও পূর্ববঙ্গের মক্কেলদের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল ছিল।
পূর্ববঙ্গে যেসব ব্যবসায়ীদের পণ্যের একচেটিয়া বাজার ছিল তারাও বঙ্গ বিভাগে শঙ্কিত হয়ে এর বিরোধিতা করে। এ প্রসঙ্গে বি. আর. অম্বেদকরের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বললেন— “The oppositions to the partition of Bengal of the part of the Bangalee Hindus, was due principally to their desire not to allow the Bangalee Muslims to take their place in Eastern Benga.
প্রবল আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে রাজা পঞ্চম জর্জ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গ বিভাগের সিদ্ধান্ত নাকোচ করে দেন। এক দশকের কম সময় ধরে আরোপিত থাকা বঙ্গবিভাগ আন্দোলনের মুখে রহিত হলেও এটি ভারতের মুসলিম রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। কারণ, পূর্ব-বাংলা এবং আসামের সমন্বয়ে গঠিত মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের মনে আশার আলো সঞ্চারিত হয়। মুসলিম শাসনের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে ভারতের একটি অংশে হলেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার স্বপ্ন তারা সযত্নে লালন করতে শুরু করে। বঙ্গ বিভাগ আন্দোলনের শরিক না হওয়ার সুবাদে এ সময় তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পায় বেশ জোরালোভাবেই।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের স্বপ্ন অচিরেই ভেঙে টুকরো হয়ে যায় বঙ্গ বিভাগ আন্দোলনের সফল পরিণতির মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তবে প্রথম ঘটনা থেকে তারা রাজনৈতিকভাবে যে সচেতন হয়ে উঠেছিল, দ্বিতীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের এ সম্পর্কে উপলব্ধি আরও বেড়ে যায়।
মুসলিম লীগ গঠন
ভারতের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে মুসলমানরা নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরবার প্রয়াসে মুসলমান সম্প্রদায় একটি রাজনৈতিক সংগঠনের তীব্র প্রয়োজন অনুভব করে। আগেই বলা হয়েছে, ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের এহেন উদ্দেশ্য থেকেই মুসলিম লীগের জন্ম। মুসলিম লীগ গঠনে কোনোও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। খোদ ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৫ সালে যেমন করে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল; ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে এসে তেমনি করেই ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় মুসলিম লীগেরও যাত্রা শুরু হয়।
১৫ এর আগে ১৯০৬ সালের অক্টোবরে আগাখানের নেতৃত্বে মুসলিম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল সিমলায় ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে। এই প্রতিনিধি দলের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের জন্য অধিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। পরে এই প্রতিনিধি দলের নাম দেওয়া হয় ‘সিমলা প্রতিনিধিদল’ বা সিমলা ডেপুটেশন (Simla Deputation)। সিমলা ডেপুটেশন ব্রিটিশ সরকারের প্রতি কিছু দাবি মেটানোর জন্য অনুরোধ জানায়। এর মধ্যে প্রধান দুটো ছিল :
ক. মুসলিম অধ্যুষিত প্রাদেশিক এবং স্থানীয় নির্বাচনে শুধু মুসলমানই প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে এবং এই প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে মুসলমান নির্বাচকমণ্ডলীর বিবেচনায়।
খ. সংখ্যানুপাতিক হারে মুসলমানদের আরও আসন এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণেই এটা হওয়া উচিত। ১৬
১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নওয়াব সলিমুল্লাহ মুসলমানদের জন্য একটি রাজনৈতিক সংগঠন করার প্রস্তাব রাখেন এবং এই সংগঠনের নাম প্রস্তাব করেন ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলা হয়, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকার এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রেখেই মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করবে। অর্থাৎ মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই মুসলিন লীগের যাত্রা শুরু হয়। ১৮
পরের বছর ১৯০৭ সালের ২৬ এবং ২৭ ডিসেম্বর দু’দিনব্যাপী করাচিতে মুসলিম লীগের প্রথম অধিবেশন সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় অধিবেশন ডাকা হয় আলীগড়ে ১৯০৮ সালে। ১৯১০ সালে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় লক্ষ্ণৌতে স্থানান্তরিত হয়। এমনি করেই পূর্ব বাংলার মানুষদের দরদ ও প্রচেষ্টায় বেড়ে ওঠা মুসলিম লীগ নামের সংগঠনটি আগ্রা ও উত্তর প্রদেশে উর্দু সমর্থিত দলের ছত্র-ছাত্রায় কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
সময়ের আবর্তনে ওই দুই অঞ্চলেই এক সময় মুসলিম লীগের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম লীগের নেতৃত্বও বাংলা এবং বাঙালি মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। বাস্তবে ব্রিটিশ প্রভাবিত গঠনতন্ত্রের কারণেই মুসলিম লীগ ব্রিটিশ ধারায় পরিচালিত এমন একটি দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়, যা ব্রিটিশদের স্বার্থসংরক্ষণে সহায়ক ছিল। আর সেজন্যই ট্রেড ইউনিয়নের কাজের দাবি, অপেক্ষাকৃত ভালো শিক্ষাব্যবস্থা এবং পদমর্যাদা বাড়ানোর কার্যক্রম এর চেয়ে খুব বেশি উচ্চমার্গের ছিল না।
সবকিছুর পরেও ভারতে মুসলিম রাজনীতির আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চারটি প্রধান বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়েছিল। সেগুলো হলো:
ক. মুসলমানদের পৃথক সামাজিক স্বাতন্ত্র্য এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় স্বতন্ত্র পরিচয় ও ঐতিহাসিক স্বীকৃতি।
খ. কংগ্রেসে হিন্দুদের আচরণের কারণে মুসলমানরা তাদের নিজেদের অবস্থান কংগ্রেসের ঠিক কোথায় তা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়।
গ. মুসলমানদের উপর প্রভাব বিস্তার নিশ্চিতকরণের চিন্তা থেকেই হিন্দুরা বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আসে।
ঘ. সকল আইন সভামণ্ডলীতে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের জন্য মুসলমানদের নিজস্ব নির্বাচকমণ্ডলী থাকতে হবে। ২১
একথা পরিষ্কার যে, মুসলিম লীগের উন্মেষ এবং বঙ্গবিভাগের মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র ছিল। মুসলমানরা একটি বিষয় তখন ভালোভাবে অনুধাবন করল যে, হিন্দুরা বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কার্যত তাদের উপরই প্রভাব টিকিয়ে রাখার পায়তারা করে। তারা অনুরোধ জানায়, আইনসভায় পৃথক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য যা পরে মর্লেমিন্টু সংস্কার আইন পাশের মধ্য দিয়ে ১৯০৯ সালে বাস্তবায়ন হয়।
এতে মুসলমানদের সংরক্ষিত আসন দেওয়া হয় আইনসভায় ও বিধানসভায় এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দেওয়া হয়। এসময় পর্যন্ত মুসলিম লীগের উপর নবাব এবং আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল পূর্ণমাত্রায়। কিন্তু ১৯১৩ সালে এই ধারাবাহিকতার পরিবর্তন ঘটে উদীয়মান জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা যখন নেতৃত্বে চলে আসেন তখন। নতুন এই জাতীয়বাদীদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন দীপ্যমান। কয়েক বছরের মধ্যে মুসলিম লীগে শিক্ষিত মুসলমানদের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে।
লক্ষ্ণৌ চুক্তি
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ভারতীয়রা যৌথ বাহিনীকেই সমর্থন দেয়। হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবেই এই সমর্থন দিয়েছেন। উদ্দেশ্য এবং আশা ছিল, ব্রিটিশরা অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান সুসংহত করবে। এ রকম প্রত্যাশা থেকেই প্রথমবারের মতো মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস যৌথ অধিবেশনে যোগদান করে। লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হওয়া ১৯১৬ সালের এই অধিবেশনে সর্বাত্মকভাবে একটি সংস্কারমূলক প্রস্তাব রাখা হয় এবং দ্রুত বাস্তবায়নেরও দাবি জানানো হয়।
মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ একমত হয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে; এটিই ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে পরিচিত। লক্ষ্ণৌ চুক্তি অনুযায়ী মুসলিম লীগ যুদ্ধের পরে ইংল্যান্ডে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে এবং কংগ্রেসও একই একই রকম একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে ভারতীয়দের সমস্যাসমূহ তুলে ধরার জন্য। কিন্তু মন্টেগু চেমসফোর্ডের রিপোর্টের মধ্য দিয়ে লক্ষ্ণৌ সন্ধির প্রত্যাশা সংকুচিত হয়ে যায়। কার্যত লক্ষ্ণৌ চুক্তির চলার পথে সীমারেখা বেধে দেয় মন্টেগু-চেম্সফোর্ড রিপোর্ট; এটি প্রকাশ করা হয় ১৯১৮ সালে জুলাই মাসে।
এই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার কারণে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ঐক্য দানাবেঁধে উঠেছিল তা সমূলে বিনষ্ট হয়। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বড় ফাঁক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় ব্রিটিশ। একসঙ্গে ভারতে মুসলমানদের বিভাজনটাও মজবুত করে নেয়। ২৩ পরিশেষে ১৯২১ সালে মন্টেগু-চেম্সফোর্ড সংস্কার কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।।
খেলাফত আন্দোলন:
ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত একটি বড় ভূমিকা পালন করে ‘খেলাফত আন্দোলন’। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তুরস্কের পক্ষ সমর্থন থেকে খেলাফত আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন।
লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিল কংগ্রেস-লীগ সে ক্ষত তখনো শুকায়নি এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক কংগ্রেস-লীগের সংস্কার প্রস্তাব বাতিল হওয়ার কারণে এমনি একটি যৌথ আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। আগেই বলা হয়েছে, প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সরকার তুর্কি সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো করার প্রতিবাদেই ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই খেলাফত আন্দোলনের ডাক দেয়।
হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সৌহার্দ্য কিছু সময়ের জন্য হলেও টিকে ছিল। এদিকে, গান্ধী ভারতে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন ১৯২০ সালে। কার্যত, খেলাফত আন্দোলন এবং গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন মিলেমিশে একটি তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় তখন। কিন্তু হঠাৎ করেই চাওড়ি-চাওড়াতে (Chauri-Chaura) উত্তপ্ত জনতা কর্তৃক কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সহিংস ঘটনায় গান্ধী এই আন্দোলন থেকে তাঁর সমর্থন তুলে নেন। আসহযোগ আন্দোলন থেকে গান্ধীজির সমর্থন তুলে নেওয়া এবং তুরস্কে খলিফা পদের অবলুপ্তি ঘোষণা— এই দুই কারণে শেষ পর্যন্ত খেলাফত আন্দোলনের প্রাবল্য স্তিমিত হয়ে আসে।
শাসনতন্ত্র পুনর্বিবেচনার জোর দাবির মুখে ১৯২৭ সালে ভারতীয়দের সন্তুষ্ট রাখার জন্য দি গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯১৯ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় দশ বছর ধরে চলা এই আইনব্যবস্থার ত্রুটি খতিয়ে দেখার জন্য একটি নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে। তখন কার্যত হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ব্যবধান আরও বেড়ে গেছে।
স্যার জন সাইমনের সভাপতিত্বে একটি বিধিবদ্ধ কমিশন গঠন করা হয় ১৯২৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর। উদ্দেশ্য, এই কমিশন শাসনতন্ত্রের সমস্যাগুলো খুব ভালোভাে খতিয়ে দেখবে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। জন সাইমনের সভাপতিত্বে গঠিত কমিশন ১৯৩০ সালের মে মাসে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকারের আহ্বানে লন্ডনে তিনটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
নেহেরু প্রতিবেদন
অসহযোগ আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরও সুদৃঢ় করার আলোকে ১৯২৮ সালে সর্বদলীয় এক আলোচনা সভার আহ্বান করা হয়। সভায় পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুকে সভাপতি করে স্বাধীন ভারতের জন একটি শাসনতন্ত্রের খসড়া করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। উল্লেখ্য যে, সাত সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির মধ্যে আলী ইমাম এবং শোয়েব কোরাইশী এই দুইজন মুসলমান সদস্যও ছিলেন। কিন্তু কমিটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে এই দুজন সদস্য তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা নিতে পারেনি।
১৯২৮ সালে এই কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নেহেরু রিপোর্ট’ শিরোনামের এই প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতাকামী হিন্দু-মুসলমানদের ফাটল এমন একটি চূড়ান্তরূপ ধারণ করে, যা কোনো মতেই আর সংস্কারযোগ্য ছিল না। কারণ, কমিটি এই প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করে তা ছিল নীতিগতভাবে সরকারের সম্পূর্ণ পক্ষে। ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি বিলোপ করা হয়।
এই ঘটনায় মুসলমানরা ভীষণ মর্মাহত হয় এবং কেন্দ্রে ও প্রদেশে অবস্থান নেওয়া মুসলিম সংগঠন তাদের স্বার্থরহিত করা এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে। ২০ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কারণ, তাদের মৌলিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রধান অংশে কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
নিলিখ ভারতে মুসলিম লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় নেহেরু প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করা হয়। জিন্নাহ মুসলমানদের প্রতিনিধি। হিসেবে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া থেকে ১৪টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন এবং এই উদ্দেশ্যগুলোই পরবর্তী দশকে মুসলিম লীগের দিক-নির্দেশনা দেয়। ১৪টির মধ্যে এখানে প্রধান চারটি বিষয় উল্লেখ করা হলো:
(ক) প্রদেশে বিভক্ত ক্ষমতা সংযুক্ত করে ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র যুক্তভাবে প্রণয়ন করতে হবে।
(খ) প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা সকল দেশের জন্য অভিন্ন হতে হবে।
(গ) দেশের সকল আইন পরিষদ এবং অন্যান্য নির্বাচিত সংস্থা নির্ধারিত পর্যাপ্ত ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। প্রদেশে বসবাসরত প্রত্যেকে সংখ্যালঘুদের কার্যকরী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বে। তবে কোনোও অবস্থাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের ক্ষমতা খর্ব করা যাবে না। তবে তা সংখ্যালঘুদের সমান হবে।
(ঘ) পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্থাৎ বিশ্বাসের স্বাধীনতা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতা মতবাদ বা মতামত, সহযোগিতা ও শিক্ষা সব সম্প্রদায়ের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। ২৫
গোল টেবিল বৈঠক
আগেই বলা হয়েছে যে, ১৯৩০ সালে সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করার পর লন্ডনে তিনটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ এই তিন বছরে অনুষ্ঠিত তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার সাইমন কমিশনের প্রতিবেদনের পরামর্শের ভিত্তিতে ভারতে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র কেমন হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩০ সালের নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠক বর্জন করলেও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকেন। বাংলা থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং মুম্বাইয়ের জাতীয়তাবাদী নেতা এস, এস, তাইবজী বৈঠকে মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২৬ কিন্তু কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে প্রথম বৈঠক কার্যত অসফল প্রমাণিত হয়।
১৯৩১ সালের শরৎকালে দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এ বৈঠকে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। কংগ্রেসের পক্ষে একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন গান্ধী এবং তিনি মুসলিম লীগ নেতাদের এ দাবি নাকচ করে দিয়ে নেহেরু রিপোর্ট সম্পর্কে আপোস মীমাংসায় আসতে বলেন। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়।
তৃতীয়বার গোল টেবিল বৈঠক ডাকা হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে, কংগ্রেস এ বৈঠকও বর্জন করে। আর এ কারণেই কোনোও চুক্তি সম্পাদিত হয়নি এ বৈঠকে। এসব ঘটনায় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে বিদ্যমান ফাটল আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানের ধারণা
ভারতের মুসলমান এবং হিন্দু এই প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক বৈষম্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা মুসলমানদের মধ্যে ক্রমশ বদ্ধমূল হতে থাকে। মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি সামনে চলে আসে ১৯৩২-৩৩ সালে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঞ্জাবি ছাত্র চৌধুরী রহমত আলীর নেতৃত্বে একদল মুসলমান ছাত্র ইংল্যান্ডে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি সরবে তুলে ধরেন। উল্লেখ্য যে, স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের ধারণা প্রথমে শুধু উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে করা হয়, যেখানে পূর্বাঞ্চলের কথা প্রায় আড়ালেই থেকে যায়।
ভারত শাসন আইন
ব্রিটিশ শাসন চলাকালে হিন্দু-মুসলমানদের রাজনৈতিক সামাজিক বিভাজনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনও একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এর মাধ্যমে ভারতে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২৮
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন একটি কঠোর কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। আর এ জন্যই মুসলমানরা এই আইন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের স্বপক্ষে যুক্তি ছিল যে, কেন্দ্রে সরকারি ব্যবস্থা কঠোর থাকার অর্থই হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা। * কারণ, এই শর্তানুযায়ী কেন্দ্রে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তারা যেকোনো মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশের প্রশাসনকে কার্যত অচল করতে পারে। মুসলিম লীগ লক্ষ্য করে, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা আসলেই অশুভ এবং প্রতিক্রিয়াশীল, মোটেও প্রগতিশীল নয় এবং অহিতকর। এসব বিশ্লেষণ থেকে মুসলিম লীগ এই আইন পরিত্যাগ করে।
যেভাবেই হোক, এই আইনের আলোকে রাজনৈতিক অঙ্গনের তথা শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কেন্দ্রে যে ছক আঁকা হয়েছিল তা অকার্যকরই থেকে যায়। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাদেশিক সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৬টি প্রদেশের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কংগ্রেস। শুধু তাই নয়, মোট ১১টির মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটো দলের একটি ছিল কংগ্রেস। মুসলমানরা তখন নিজেদেরকে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় উপস্থাপনে প্রায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং নেতাদের মধ্যে যারা এই বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যাশী ছিলেন তারা আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাধারাকে নীতিগতভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়।
মুসলিম লীগের প্রধান নেতা জিন্নাহ
কংগ্রেসের কর্মকান্ডে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া থেকেই সরাসরি পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাধারা প্রকাশ পায়। কারণ, কংগ্রেস তখন একটি কঠোর ও শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে এবং শাসনতন্ত্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এসবই মুসলমানের চিন্তাধারায় তাদের স্বাধিকারের প্রশ্নে আরও ইন্ধন জোগায়। ১৯৩৫-৩৭ সালের মধ্যে জিন্নাহ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের কঠোর বিরোধিতা করেন।
এই বিরোধিতার স্বপক্ষে তাঁর যুক্তি ছিল যে, এই শাসনতন্ত্র সকল শ্রেণির লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মুসলমান নেতারা মুসলমানদের অভাব অভিযোগের যে চিত্র তুলে ধরে কেন্দ্রীয় সরকার সেদিকে বেশি গুরুত্ব দেয় না। এ সময়ে এবং পরের দু’বছরে ভারতে মুসলিম লীগের উন্মেষ প্রত্যক্ষ করা হয়। শুধু তাই নয়, মুসলিম লীগ তখন সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধীদল হিসেবে মুসলমান রাজনৈতিক সচেতন লোকদের তথা গোটা ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম লীগের এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল জিন্নাহ’র প্রগতিশীল নেতৃত্বের কারণে।
বাস্তবে ১৯২৮ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ভারতে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব অকার্যকর ছিল। এদিকে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক নোত স্যার সিকান্দার হায়াৎ খান এবং বাংলার আবুল কাশেম ফজলুল হকদের মতো নেতারা প্রাদেশিক রাজনীতিতে এত বেশি ডুবে ছিলেন যে, তাঁদের পক্ষে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ রাখা কার্যত অসম্ভব ছিল। আবুল কালাম আজাদ তখন পুরোপুরি কংগ্রেসের রাজনীতিতে ছিলেন এবং তিনি নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রখর বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রতিযোগিতা করার মতো তখন কেউ ছিল না। ফলশ্রুতিতে ১৯৩৮ সালে এবং ১৯৪২ সালের শেষ পর্যন্ত লীগ মুসলমান অধ্যুষিত ছাপ্পান্নটি আসনের মধ্যে ৪৬টি আসনে জয়লাভ করে। এই সময়ে পাঞ্জাবের এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রীদ্বয় তাদের বেশিরভাগ অনুসারীদের নিয়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্ব
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্বের মধ্য দিয়ে ‘স্বাধীন পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের উন্মেষ ঘটে— যা বহুদিন আগে থেকেই জাতি হিসেবে মুসলমানদের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের উদগ্র বাসনায় সচেতন হয়ে সতর্ক বিচরণ করছিল ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে। মূলত মন্টেগু চেমস্ফোর্ড রিপোর্টে মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচন পদ্ধতির ব্যাপারে মুসলমানদের মনে স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র গঠনের নীরব সমর্থন ছিল।
নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্রিটিশরা সুকৌশলে মুসলমানদের মনে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অনুভূতি গড়তে সহায়তা করে। কাজেই বলা যায় যে, জিন্নাহ ভারতে মুসলমানদের আলাদা জাতি গঠনের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন না; কারণ তার আগেই কয়েকজন মুসলমান নেতা ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের পৃথক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান এদের বলতেন কওম (Quam) যার অর্থ হলো জাতি। আগা খান, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখও পৃথক ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তা’র কথা তুলেছেন। কিন্তু জিন্নাহ বিষয়টির চূড়ান্ত ঘোষণা দেন।
১৯৩৮ সালের অক্টোবরে সিন্ধুতে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক অধিবেশনে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, হিন্দু এবং মুসলমান দুটো পৃথক জাতি। ১৯৪০ সালে (Time and Tide) শিরোনামে লেখার মধ্যে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব পরিষ্কার করে তুলে ধরেন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক আরোপিত ভারতীয় শাসনতন্ত্রের পুনর্গঠনে নির্ধারিত যৌথ কমিটির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোচনায় বলেন:
“India is inhabited by many races often as distinct from one another in origin, tradition, manner of life as are nations of Europe, Two thirds of its inhabitants profess Hinduism in one from or other as their religion, over seventy millions are followers of Islam and the difference between the two is not only of religion in the strict sense but also of law and culture.”
অর্থাৎ: “ভারতবর্ষে বহুজাতির বহুবর্ণের সমাবেশ। কিন্তু প্রায়ই এসব জাতি গোষ্ঠী ইউরোপের মতোই এদের উৎপত্তি, ঐতিহ্য, জীবনাচার একগোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীর আলাদা বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে বসবাসকারী মানুষের তিনভাগের দুই ভাগই একই আচারে হিন্দুবাদে বিশ্বাসী; অথবা অন্যরা তাদের নিজের মতো ধর্ম পালন করে। এখানে সাত কোটিরও বেশি লোক ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। এই দুই ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন লোকেদের মধ্যে শুধু যে ধর্মীয় আচারে পার্থক্য তা নয়, এদের মধ্যে রীতিনীতি এবং সংস্কৃতিতেও একটি বড় ব্যবধান রয়েছে। ৩৫
মজার ব্যাপার হলো, হিন্দুমহাসভার প্রতিষ্ঠাতা লালা লাজপৎ ১৯২৪ সালের শুরুতেই হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা উল্লেখের দাবি রাখে যে, মুসলিম লীগ পরবর্তী স্বতন্ত্র মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের যে দাবি তোলে, তার ভিত্তি ছিল আসলে ওই হিন্দু মহাসভা প্রধানের প্রস্তাবিত সূত্র এবং পরে এটাই পাকিস্তান দাবির ঐতিহাসিক ‘লাহের প্রস্তাব’ বলে পরিচিত।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব
১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ-মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাধারাকে স্পষ্ট ভাষায় রূপ দেন। এটাই ছিল ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’। এই প্রস্তাবে মূলত তিনটি রাষ্ট্র গঠন করার কথা। বলা হয়।৩৭ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল এই দুটি হবে মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। কারণ, এ অঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই দুটো বাদে ভারতের বাকি অংশ মিলে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
এই তৃতীয় রাষ্ট্র হবে হিন্দুদের আবাসভূমি। কিন্তু পরে কংগ্রেসের সামনে তাদের এই ইস্যু মুখোমুখি হলে মুসলমানদের ঐক্য আরও দৃঢ়ভাবে প্রদর্শনের প্রয়োজন দেখা দেয়— যা তারা করতে পারেনি। এজন্যই শেষ পর্যন্ত দুটো মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব তখন একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের খাতে প্রবাহিত হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র। যেভাবেই হোক, অবাস্তব এবং বৈষম্যপূর্ণ আচার-রীতি এবং ভৌগোলিক দূরত্ব – এসবের কোনো কিছুই বিবেচনায় আসেনি তখন এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর জোর দিয়েই শেষ পর্যন্ত এই দুটো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পৃথক রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্রুত কার্যকরের পথে যায়।
ক্রিপস মিশন
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্সকে ব্রিটিশ সরকার তার প্রতিনিধি করে ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ভারতে পাঠায়। তাঁর দায়িত্ব ছিল, ভারতের স্বাধীনতার সম্ভাব্যতা এবং প্রক্রিয়া যাচাই করা। ক্রিপ্স মিশন মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি সমর্থন করে পরামর্শ উপস্থাপন করে যে, ভারতে দুই বা ততোধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। কিন্তু উভয় পক্ষ থেকে এই পরামর্শ নাকচ করে দেওয়া হয় এবং ক্রিপ্স মিশন শেষ অবধি অসফলভাবেই শেষ হয়।
মন্ত্রী পরিষদ মিশন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার এমনি সময়ে ভারতে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের মিশন পাঠায়। ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো এ মিশনের প্রধান ছিলেন রাষ্ট্রের সচিব নিজে। আগেই বলা হয়েছে, ক্রিপ্স মিশন পাঠানো হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই এবং তা বিফল হয়েছিল। বর্তমানে মিশনটি আগেরটির ফলোআপ। মিশন দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা অব্যাহত রাখে। প্রাদেশিক রাজনৈতিক প্রতিনিধি, উগ্রপন্থি, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী দলের নেতা এবং সর্বোপরি ভারতের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করে।
শুধু তাই নয়, পেশাদার সংগঠনসমূহের সঙ্গেও মিশন বিস্তারিত আলোচনা করে। মোদ্দাকথা, ক্রিপ্স মিশন যে রকম তড়িঘড়ি করে একটি পরামর্শ দাঁড় করিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ধোপে না টিকে নাকচ হয়ে যায়— মন্ত্রী পরিষদ মিশন তেমনটি না করে, ভারতের সর্বস্তরের জনতার প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করে। মিশনটি কার্যক্ষেত্রে পাকিস্তানের সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দেয় এবং বিকল্প হিসেবে তিনি উপ-ফেডারেশনসহ (কেন্দ্র) একটি শিথিল ফেডারেশন গঠনেরও পরামর্শ দেয়।
কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয় দলই মিশনের এই বিকল্প পরামর্শ গ্রহণ করে। শাসনতন্ত্রের চুক্তির বিষয়গুলো যখন সামনে চলে আসে তখন কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি পণ্ডিত নেহেরু এক সাক্ষাৎকারে বললেন অন্যকথা। তিনি বললেন, “কংগ্রেস মন্ত্রী পরিষদের অংশীদার হিসেবে তাদের পরিকল্পনা পরিশুদ্ধকরণের ক্ষমতা রাখে।” আসলে পণ্ডিত নেহেরু ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা বিলুপ্ত করার আশা করেছিলেন। এটাই ছিল অবিভক্ত ভারত টিকিয়ে রাখার শেষ সুযোগ।
ক্যাবিনেট মিশনও ব্যর্থ হলো এবং তার পরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে খুব দ্রুত এবং ভারতের তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়। আগে থেকেই চলতে থাকা হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের টানাপড়েন এবার দ্রুত অবনতির দিকে যায়। ফলে কংগ্রেস নেতাদের আপত্তি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ভারত বিভাগ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না– এটি কঠিন একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এমনি যখন অবস্থা তখন ব্রিটিশ সরকার খুব শিগগিরই দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হাতে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরও বলা হয়, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগেই এই কাজ সম্পন্ন হবে।
” মাউন্টব্যাটেনের প্রচেষ্টা এবং প্যাটেলের বিবাদমান চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বঙ্গ বিভাজনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু নেহেরুর চেষ্টা ছিল কূটনৈতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টিকে নিজেদের স্বপক্ষে নিয়ে আসা। প্রথমে নেহেরুর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। অতঃপর গান্ধী একের পর এক প্রবল যুক্তি দাঁড় করাতে থাকেন। অবশ্য প্রথমেই গান্ধী বলেছিলেন যে, বঙ্গবিভাগ হবে তাঁর লাশের ওপর দিয়ে।
যাহোক, ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য দুটো গণ-পরিষদ গঠিত হলো, বাংলা এবং আসাম বিভক্ত হলো এই ভিত্তিতে যে, সিলেটের আসামে এবং সীমান্ত প্রদেশের মধ্যে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এভাবেই পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান এবং ভারত নামের দুটো আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উন্মেষ ঘটে যথাক্রমে ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট তারিখে।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা
লাহোর প্রস্তাবের কয়েক বছর পর ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল দিল্লিতে লাহোর প্রস্তাবের এবং মুসলিম লীগের বিধানকারীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের ৯ তারিখেই তৎকালীন যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে ‘যুক্ত- প্রদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যে কারণেই হোক, বাঙালি মুসলমানরা একটি সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিল না। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম বাংলার মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে উপরের প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন।
তাঁর যুক্তি ছিল যে, ১৯৪০ সালে দুটো পৃথক মুসলমান স্বাধীন রাষ্ট্রের যে প্রস্তাব করা হয়েছিল বর্তমান প্রস্তাবটি তার পরিপন্থি এবং বিবাদমান পরিস্থিতির উন্মেষ ঘটাতে পারে। তিনি আরও যুক্তি দাঁড় করান যে, ভৌগোলিক কারণেই দুটো দেশের মধ্যে রয়েছে দূরত্ব আর এ দূরত্বের কারণে দু’টো দেশ প্রকৃতপক্ষে একেবারেই আলাদা এবং তা প্রায় সবকিছুতেই। সুতরাং এমন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পূর্ব ও পশ্চিমে অবস্থানরত দুটো দেশকে একই শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব।
উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালে আবুল হাশিম যেসব যুক্তি দেখিয়েছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসম শাসন ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা প্রমাণিত হয়। ফলশ্রুতিতে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনে থাকতে অস্বীকৃতি জানায় অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটে। বলা হয়েছিল জিন্নাহর State শব্দটিই ভুল ছিল বরং শব্দটি States হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। আবুল হাশিমকে জিন্নাহ নিশ্চিত করেছিলেন যে, State রাষ্ট্র অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য একটি রাষ্ট্র অবশ্যই সমঅধিকারের ভিত্তিতে হবে। এটা কখনই পূর্বাঞ্চলের মানুষদের বিপক্ষে যাবে না। ৪২
যুক্ত বাংলার ধারণা
পূর্বেই বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় কখনই একটি যৌথ মুসলমান রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিল না। কিন্তু এ অঞ্চলে তখন মাঝে মধ্যে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা সংগঠিত হতো। তা সত্ত্বেও ভাষাগত মিল এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বন্ধন সৃষ্টি করেছিল, যা সবকিছুর পরেও তাদের মধ্যে একতা বজায় রাখতে পেরেছিল। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবে যথাক্রমে শরত্চন্দ্র বসু ( নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাই) এবং আবুল হাশিম যুক্ত বাংলার স্বপ্রমাণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
একইভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিও বৃহত্তর বাংলার বা যুক্ত বাংলার দাবি জানায়। তাঁরা পরামর্শ দেন যে, বৃহত্তর বাংলার কার্যকরী পরিষদে বা সরকারে হিন্দু-মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব হবে সমান এবং এর প্রধান কার্যালয় বা রাজধানী হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে হতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই হবে একজন মুসলমান। ৪৪ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়।
বিরোধিতা শুধু যে ব্রিটিশ সরকার করে তা নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে সমর্থন দেওয়া মুসলিম নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং মাওলানা আকরাম খান প্রমুখও বিরোধী শিবিরে অবস্থান নেন। এদিকে কংগ্রেস নেতা নেহেরু, প্যাটেল এবং হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামা প্রসাদও এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয়, বাংলা এবং পাঞ্জাব বিভক্ত হবে সেসব দেশের জনগণের অবস্থার উপর ভিত্তি করে। বাঙালি শীর্ষ নেতাদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ সরকার রায়, সত্য রঞ্জন বক্সী এবং ফজলুর রহমান ক্ষুব্ধ মনোভাব ব্যক্ত করে যুক্ত বাংলার পক্ষে অবস্থান নেন।
কিন্তু এদের মধ্যে আবুল হাশিমই বিচক্ষণ বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করেন যে, “বাংলাকে বিভক্ত করার পিছনে ইঙ্গ-মার্কিন পুঁজিবাদের হাত রয়েছে এবং তাদের উদ্দেশ্য মোটেও সৎ নয়। তাদের উদ্দেশ্য ভাগ করে দিয়ে বাংলাকে দুর্বল করা এবং এটা তারা করতে চায় নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য।”
এহেন অবস্থায় মুসলিম লীগের একটি লাভ হয়েছিল। কারণ, মুসলিম লীগের যেসব নেতা বাঙালি মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন তারা বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগ ছেড়ে যান। যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাও দল থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরিশেষে বাংলা এবং পাঞ্জাব জনসাধারণের উপর নির্ভর করেই বিভক্ত হয়ে গেল। পাঞ্জাবের পশ্চিমাঞ্চল এবং বাংলার পূর্বাঞ্চল মিলে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের উন্মেষ ঘটল। পূর্ব পাঞ্জাব এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু বসতি অঞ্চল মিলে সৃষ্টি হলো অবিভক্ত রাষ্ট্র ভারত।
তথ্যসূত্র
১. অমলেন্দু দে, Islam in Modern India, কলকাতা, ১৯৮২, পৃ. ১, আরও দেখা যেতে পারে: নীলকান্ত শাস্ত্রী, A History of South India, মাদ্রাজ, ১৯৭৬, পৃ. ৪৩৯।
২. মালাব জেলা গেজেট, মাদ্রাজ, ১৯০৮, পৃ. ১৯০।
৩. কে, কে, আজিজ, The Making of Pakistan: A Study of Nationalism, লন্ডন, ১৯৬৯, পৃ. ১৭-১৯।
৪. ব্লেয়ার বি, কিং, The Blue Mutiny, ফিলাডেলফিয়া, ১৯৬৬, পৃ. ৮।
৫. হাজী শরীয়তুল্লাহর অনুসারীরা মুসলমানদের জন্য বিদেশি শাসন ব্যবস্থা রহিত ঘোষণা করে এবং এর নাম দেওয়া হয় দার-উল-হার্ব (Dar-ul-Harb)
৬. শাসনতন্ত্রের পুনর্গঠন শুরু হয় ১৮৬১ সালে এবং ভারতীয়রা তখন থেকেই আস্তেধীরে এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে আরম্ভ করে।
৭. বিস্তারিত তথ্যের জন্য বি, বি, মিশ্র, The India Middle Class: Their Growth of Modern times, দিল্লি, ১৯৭৮ বইটি দেখা যেতে পারে। ইয়র্ক, ১৯৬৬, পৃ. ১৮।
৮. ওয়েনে আইরিস উইলক্স, Pakistan, নিউ
৯. পাতাবি সিতারামায়া, History of the Indian Congress, প্রথম খণ্ড, দিল্লি, ১৯৬৬, পৃ. ১৫। National
১০. উপরোল্লিখিত বই, পৃ. ৩৯।
১১. উপরোল্লিখিত বই, পৃ. ২৬-২৭।
১২. ওয়েনে আইরিস উইলক্স, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮।
১৩. বিস্তারিত জানার জন্য রিচার্ড সাইমণ্ডের The Making of Pakistan, লন্ডন, ১৯৫১, পৃ. ৪০ দ্রষ্টব্য।
১৪. বি আর আম্বেদকর, Pakistan or partition of India, বোম্বে, ১৯৪৫, পৃ. ১১১।
১৫. উপরোল্লিখিত গ্রন্থ, পৃ. ২৩।
১৬. তারা চন্দ্র, History of the Freedom Movement in India, তৃতীয় খণ্ড, নতুন দিল্লি, ১৯৭২, পৃ. ৩৯৮-৯০।
১৭. মোহাম্মদ নোমান, Muslim India, এলাহাবাদ, ১৯৪২, পৃ. ৭।
১৮. উপরোল্লিখিত গ্রন্থ, পৃ. ৭৮।
১৯. ডি, এন, ব্যানার্জি, East pakistan, দিল্লি, ১৯৬৯, পৃ. ১৪।
২০. ওয়েনে আইরিস উইলক্স, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০।
২১. কে, কে, আজিজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯ পৃষ্ঠা।
২২. The Manchester Guardian, জানুয়ারি ২, ১৯১৭।
২৩. কে, কে, আজিজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫ ।
২৪. ১৯২৮ সালের ৭ এবং ১০ সেপ্টেম্বরের প্রস্তাবসমূহ যা যথাক্রমে এবং ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ তারিখে প্রকাশিত হয়।
২৫.বিস্তারিত তথ্যের জন্য : শরীফ আল মুজাহিদ, Quaid-1-Azam Jinnah, করাচি, ১৯৮১, পৃ. ৪৭৪ দ্রষ্টব্য।
২৬. ডি, এন, ব্যানার্জি, East Pakistan, দিল্লি, ১৯৬৯, পৃ. ২৫। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিনিধি ছিলেন মহামান্য আগা খান, স্যার আহমেদ সাঈদ খান ছত্রী, স্যার আবদুল রহিম, নবাব স্যার আবদুল কাইয়ূম খান, স্যার আবদুল হালিম গজনবী, স্যার সৈয়দ আলী ইমাম, এ কে ফজলুল হক, স্যার গোলাম হোসাইন, স্যার জিন্নাহ, স্যার মোহাম্মদ ইকবাল, সৈয়দ মোহাম্মদ বাদশা সাহেব বাহাদুর, মৌলবী মোহাম্মদ শাফী দাউদী, নবার স্যার সৈয়দ মোহাম্মদ মেহের শাহ, স্যার শাহ নেওয়াজ খান ভুট্টো, স্যার সৈয়দ সুলতান আহমেদ, মাওলানা শওকত আলী, এস, এস, তাইবজী, স্যার জাফরুল্লাহ খান এবং খান বাহাদুর হাফিজ হিদায়েত হোসাইন প্রমুখ।
২৭. কে, কে, আজিজ, পূর্বোক্ত পৃ. ৪৪-৪৬।
২৮. মোহাম্মদ মুনীর, From Zinnah to Zia, নতুন দিল্লি, ১৯৭৯, পৃ. ৩০ ।
২৯. আর, ল্যান্ড, India: A Re-Statement, লন্ডন, ১৯৪৫, পৃ. ১৪৪।
৩০. উইলিয়াম বাটন, The State and the White Paper, এম্পায়ার রিভিট, জানুয়ারি ১৯৩৪, পৃ. ২১। আরও দ্রষ্টব্য : Resolution No. 8 of the All India Muslim League of 11-12 April 1963 এবং Resolutions of All India Muslim League এর মে ১৯২৪ থেকে ডিসেম্বর ১৯৩৬, দিল্লি, পৃ. ৬৬-৬৭ দ্রষ্টব্য।
৩১. জামিল উদ্দিন আহম্মেদ (সম্পাদিত), Speeches and writing of Mr, Jinnah, 1952, পৃ. ১২১, The committee appointed by the council of All India Muslim League to inqure into Muslim gravances in Congress Previnces, The Report (the Pirpur Report), দিল্লি, ১৯৩৮, অন্য একটি কমিটিও তখন নিযুক্ত হয়েছিল, ওয়াদা স্মিথ রিপোর্ট (Kamal Yar Jung Committee Report), কলকাতা, ১৯৪২।
৩২. এ, সি, ব্যানার্জি, Two Nations, নতুন দিল্লি, ১৯৮১, পৃ. ২৩০।
৩৩. আর, কপল্যান্ড, India politics, ১৯৩৬-১৯৪২, দ্বিতীয় খণ্ড, নির্ঘণ্ট-৬, লন্ডন, ১৯৪৩।
৩৪. এ, কে, আজিজ, উপরোল্লিখিত গ্রন্থ দ্রষ্টব্য, পৃ. ১৬৩।
৩৫. জামিল উদ্দিন আহমেদ (সম্পাদিত) উপরোল্লিখিত গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের পূ ১১৬-১৭। আরও দ্রষ্টব্য Resolutions of All India Muslim League, অক্টোবর ১৯৩৭ হতে ডিসেম্বর ১৯৩৮, সংযোজন পৃ. ৬৫-৬৮, আই এইচ কোরেশী, The Struggle for Pakistan, করাচি, ১৯৬৫, পৃ. ১২৬।
৩৬. রিচার্ড সাইমন, উপরোল্লিখিত গ্রন্থের উদ্ধৃতি, পৃ. ৫৯।
৩৭. পরে স্যার সিকান্দার হায়াৎ খান পাঞ্জাবের আইনসভায় বিবৃতি দেন ‘এটা বলা হয় যে, আমি লাহোর প্রস্তাবের রচয়িতা, আমার স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে, আমিই মূল প্রস্তাবটির খসড়া তৈরি করেছিলাম কিন্তু পরে আমি জানতে পেরেছি, যে প্রস্তাবটি আমি খসড়া করেছিলাম তাতে কমিটি কর্তৃক কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছিল।’
“It has been said that, I am the author of Lahore Resolution, I have no hesitation in admiting that I was responsible for drafting the original resolution but let me make it clear that the resolution which I drafted was radically amended by subject committee.”
কামরুদ্দিন আহমেদ তাঁর A Socio-Political History of Bengal and Birth of Bangladesh, ঢাকা, ১৯৭৫, পৃ. ৪৭, গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। বিস্তারিত তথ্যের জন্য লাহোর প্রস্তাব পরিশিষ্ট ‘১’ দ্রষ্টব্য।
৩৮. মোহাম্মদ মুনীর, উপরোল্লিখিত গ্রন্থের পৃ. ৩২।
৩৯. পরমাত্মা শরবান, উল্লিখিত গ্রন্থের পৃ. ২১।
৪০. মাওলানা এ, কে, আজাদ, India Wins Freedom, বোম্বে, ১৯৫৯, পৃ. ২১৯।
৪১. সৈয়দ শফিউদ্দিন পীরজাদা উল্লেখিত গ্রন্থের পৃ. ২৪৯ এবং ২৫৬।
৪২. এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চৌধুরী খালিকুজ্জামান যে ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রস্তাবের খসড়া করতে গিয়ে States শব্দটি পরিবর্তন করে State শব্দ লিখেছিলেন এবং প্রস্তাবে কমিটি গঠিত হয়েছিল নবাব ইসমাইল খানের সভাপতিত্বে। এতে খালিকুজ্জামান ছাড়া আরও ছিলেন হাসান ইস্পাহানি, আবদুল মতিন চৌধুরী এবং ইসমাইল ইব্রাহীম চুম্ব্রিদার ।
এখানে আরও উল্লেখ করা যায় যে, উপরে যে সব ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের কেউই বাঙালি ছিলেন না এবং কোনো বাঙালি প্রতিনিধি এই খসড়া কমিটিতে ছিল না। বিস্তারিত তথ্যের জন্য (ক) কুলদীপ নায়ার, Distant Neighbour, দিল্লি, ১৯৭২, পৃ. ১৬, (খ) ডি, আর, মাক্কেকর, Pak-Colonialism in East Bebgal, নতুন দিল্লি, ১৯৭১, পৃ. ৪৮, (গ) চৌধুরী খালিকুজ্জামান, Pathway to Pakistan, লাহোর, ১৯৬১ দ্রষ্টব্য।
৪৩. কামরুদ্দিন আহমেদ, পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থের পৃ. ৭৯।
৪৪. উপরোল্লিখিত গ্রন্থের পৃ. ৮০; আরও দ্রষ্টব্য The Appendix ‘B’ for the text on United Bengal যা শরৎচন্দ্র বসু এবং আবুল হাশিম বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন।
৪৫. এম, এ, রহিম, Muslim Society and politics of Bengal, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃ. ৩২৪-৩৩৯। এ প্রসঙ্গে আয়েশা জালাল বলেন, কংগ্রেস ভাগাভাগির ক্ষেত্রে যেমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ঠিক জিন্নাহ তেমনি ভাগাভাগির বিপক্ষে অবস্থান নেন। ড. রফিক উদ্ধৃতি দেন যে, জিন্নাহ কোনো দিনই পাকিস্তান চাননি। এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয় Sunday Review: The Times of India, বোম্বে, সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৮৫। আয়েশা জালালের একটি বই পরিচিত The Sole Spokesman, ক্যাম্ব্রিজ ১৯৮৫। আরও দ্রষ্টব্য শিলা সেন, Muslim Politics in Bangal, নতুন দিল্লি, ১৯৭৬, পৃ. ২৪৩।
৪৬. সিরাজুদ্দিন হোসেন, Looking into the Miron, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃ. ১০১-১০৫।
Read more:

![পাকিস্তানের উন্মেষ [ The rise of Pakistan ]](https://politicsgurukul.com/wp-content/uploads/2024/02/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B7-The-rise-of-Pakistan--1024x536.jpg)