ঐতিহাসিক ৬ দফা ও আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন – সরদার সিরাজুল ইসলাম : শেখ মুজিবুর রহমান পেশকৃত ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি লাহোর সর্বদলীয় সম্মেলনে (৬ ফেব্রুয়ারি ‘৬৬) শুধু প্রত্যাখ্যাতই হয়নি, পরদিন করাচীর ইংরেজি পত্রিকা ‘ডন’ উর্দু পত্রিকা ‘জং’সহ পশ্চিম পাকিস্তানের সকল পত্রিকা এবং ঢাকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ‘পয়গাম’সহ অন্যান্য সরকারি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠার ব্যানার হেডলাইনে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া হয়।

[ ঐতিহাসিক ৬ দফা ও আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন – সরদার সিরাজুল ইসলাম ]
এতে তার জীবন বিপন্ন হলে তিনি সর্বদলীয় কনফারেন্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে করাচীতে সোহরাওয়ার্দীর লাখাম হাউসে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সোলায়মানও ৬-দফা প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। অবশেষে ১১ ফেব্রুয়ারি ‘৬৬ (শুক্রবার) ঢাকায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে ৬-দফার ব্যাখ্যা করেন। দফাগুলো ছিল :
(১) ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত সদস্য কর্তৃক শাসনতন্ত্র রচনা করত পার্লামেন্টারি সরকার পদ্ধতিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনে পরিবর্তিত করা।
(২) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র থাকবে অবশিষ্ট বিষয়সমূহ ফেডারেটিং স্টেটের (প্রদেশ নয়) আওতাভুক্ত থাকবে
(৩) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি অথচ অবাধ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। ২টি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। অথবা একটি মুদ্রাব্যবস্থা, কিন্তু দুটি আলাদা রিভার্জ ব্যাংক এবং কেন্দ্রে একটি ফেডারেশন রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে-যা থেকে পশ্চিম পাকিস্তান মুদ্রা পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
(৪) সকল প্রকার ট্যাক্স ধার্য ও আদায় ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে । কেন্দ্রকে নির্ধারিত অঙ্কের রাজস্ব দেবে যা আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকে জমা হবে।
(৫) বৈদেশিক বাণিজ্য আঞ্চলিক সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। যার যার বৈদেশিক মুদ্রা তার কাছে পৃথকভাবে জমা থাকবে। আনুপাতিক হারে কেন্দ্রীয় সরকার তার হিস্যা পাবে। দেশজাত পণ্য বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি চলবে।
(৬) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারামিলিশিয়া রক্ষীবাহিনী থাকবে।
৬-দফা প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সর্বপ্রথম ১৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বিবৃতি দেন চট্টগ্রামের জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এমএ আজিজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ২১ বিশিষ্ট আইনজীবী পত্রিকায় এক বিবৃতিতে ৬-দফাকে সময়োচিত কর্মসূচী বলে সমর্থন করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের এক বিশেষ সভায় বঙ্গবন্ধু ৬-দফা দাবি প্রস্তাবাকারে পেশ করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। আইয়ুব খান ৬-দফাকে অস্ত্রের ভাষায় মোকাবেলার হুমকি দেন। চালান নজিরবিহীন নির্যাতন। আর ভুট্টো চেয়েছিলেন বাহাস, তবে শেষ পর্যন্ত পিছুটান।
৬-দফা নিয়ে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া প্রথমে অভিমানবশত শেষ মুজিবের সঙ্গে মন কষাকষি করে কিন্তু তা অল্প সময়ে দূর হয়। ৬-দফার সমর্থনের জন্য দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ ছিল তিন বছর। কিন্তু জেল, আর্থিক সঙ্কটসহ শত নির্যাতনের মুখেও শেখ মুজিবের মতো মানিক মিয়াও মাথা নত করেননি।

৬-দফার পক্ষে বক্তব্য রাখার দায়ে ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার, নিউনেশন প্রেস বাজেয়াফত ও দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। ৯ আগস্ট ৬৬ ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত বাজেয়াফত আদেশ অবৈধ ঘোষণা করলে গভর্নর মোনায়েম খান এক আদেশবলে পুনরায় বাজেয়াফত করেন। গণআন্দোলনের চাপে (ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে ৯ নম্বর দফা ছিল ইত্তেফাককে নিয়ে) ১৯৬৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
৬-দফার প্রচারে শেখ মুজিব প্রথম জনসভা করেন চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ২৫ ফেব্রুয়ারি ৬৬ শুক্রবার। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লাখো জনতার বিশাল সমাবেশে জননেতা এম এ আজিজ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব ৬-দফাকে সমর্থন জানানো হয়
শেখ মুজিব বলেন, জনগণ শক্তিশালী পাকিস্তান চায়, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নয় এবং দু’দফাই শক্তিশালী পাকিস্তানকে নিশ্চিত করবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘৬৬ নোয়াখালীর জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ছ’দফা হচ্ছে পূর্ববঙ্গের ওপর অবিচারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ও ন্যায়সঙ্গত দাবি যা দুই প্রদেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে সক্ষম।
ছ’দফা যখন প্রথম উচ্চারিত হয় শেখ মুজিব ছিলেন সাধারণ সম্পাদক সভাপতি ছিলেন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৮-২০ মার্চ ‘৬৬ তিন দিনব্যাপী ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ১৪৪৩ কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ৬-দফার প্রতি আস্থা প্রকাশ ও নতুন কার্যকরী কমিটি গঠন করেন।
সেই কমিটির সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক । সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহম্মদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। শ্রম সম্পাদক জহুর আহম্মদ চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী।
কাউন্সিল নির্বাচনের শেষ দিন ২০ মার্চ ‘৬৬ পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসমাবেশে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন। ৬-দফা দাবি আদায়ের পথ যতই পিচ্ছিল হোক না কেন তিনি তা থেকে পিছপা হবেন না, এমনকি জীবনের বিনিময়ে হলেও তা বাস্তবায়ন করবেন।’ কেবল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় দেশের উভয় অংশকে শক্তিশালী না করে পাক ভারত যুদ্ধের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে কেন বলেন, চীনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে আর কেনইবা বলেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করলে তারা দিল্লী দখল করবেন।

৬-দফার প্রচারে বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন ৮ মে ৬৬ পর্যন্ত। এই দু’মাস সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফরে বের হন। কিন্তু সরকারি নির্যাতন এমনি পর্যায়ে পৌঁছে যা নজিরবিহীন। সিলেটে এক জনসভায় ‘আপত্তিকর’ ভাষণ দিয়ে তিনি যশোরে যান, সেখান থেকে ২১ এপ্রিল তাঁকে গ্রেফতার করে সিলেটে পাঠানো হয়।
সিলেট থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে, ময়মনসিংহ জনসভায় ‘আপত্তিকর’ ভাষণের অজুহাতে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ পাঠানো হয়। সেখান থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ৮ মে নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে ঢাকায় ফিরলে রাত ১টায় তাকে দেশরক্ষা আইনে বন্দি করা হয়। (যার পরে দীর্ঘকাল কারাগারে অবস্থানকালে ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে পুনরায় বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
গণআন্দোলনের ফলে মুক্তি লাভ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি, ‘৬৯)। শেখ মুজিব গ্রেফতারের পর কিছুদিনের মধ্যে শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করা হয়। মুজিবের আটকের প্রতিবাদে এবং ছয় দফার সপক্ষে প্রথম প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। দিনটি যাতে পালন করতে না পারে সেজন্য মোনায়েম খান সবিশেষ তৎপর ছিলেন। পূর্বদিন রাতে বেতারভাষণে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি সাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দিয়ে মোনেম খান তাঁর চিরাচরিত ভাষণ দেন।

৬ জুন ছিল প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। গভর্নর মোনায়েম খান প্রাদেশিক পরিষদে ভাষণ দিতে গেলে বিরোধী দলের সদস্যরা পরিষদ বর্জন করে হরতালের প্রতি জুন সকাল শমিকের সমাবেশে তেজগাঁওয়ে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি এক জ্বালাময়ী দেন। সভাশেষে এক বিক্ষোভ বের হয়।
পুলিশ মিছিলের ওপর আক্রমণ প্রথমে শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ পুলিশ গুলি চালায়, যার ফলে ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়। মধ্যে সিলেটের অধিবাসী বেঙ্গল বেভারেজ কোম্পানির শ্রমিক মনু ঘটনাস্থলে তাঁর নুরে সিদ্দিকীসহ মিছিল বের করেন। উক্ত ঘটনায় তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা আরও বিক্ষুব্ধ এবং তেজগাঁও রেল ক্রসিং দিয়ে থেকে আগত ট্রেনটি পথিমধ্যে থামিয়ে দেয়। ট্রেনটি পুনরায় চালাবার চেষ্টা করলে লাইনচ্যুত হয়।
এই আন্দোলন থামাতে পুলিশ ইপিআর বাহিনী ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি ছোঁড়ে। এর একটি গুলি আজাদ ও ফ্যাক্টরির ছাঁটাইকৃত শ্রমিক নোয়াখালীর আবুল হোসেনের পায়ে বিদ্ধ হয়। আবুল হোসেন উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে বুকে গুলি চালানোর আহ্বান তার বক্ষভেদ করে ছোঁড়ে এবং আবুল হোসেন শাহাদাতবরত করেন। এখানে পুলিশের গুলিতে আরও ৫ জন হয়। দুপুর থেকে পল্টনমুখী এক জঙ্গীমিছিল মোটরস, হোটেল শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন সেগুনবাগিচার মোড়ে সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টনীর সম্মুখীন হয়। ছাত্রনেতৃবৃন্দ হল প্রাঙ্গণে সমবেত জানায়। তখন জঙ্গীমিছিল হয়।
জুন নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ কলকারখানা বন্ধ রাখে। জনতা রেলওয়ের শ্রমিকদের ওপর হামলা চালালে পুলিশের জন ঘটনাস্থলে যান। তা সত্ত্বেও শ্রমিক নেতা সাদুর লক্ষাধিক শ্রমিক-জনতা পোস্তগোলা, ডেমরা, থেকে মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ি পৌঁছলে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় পল্টনে জনসভা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পুলিশ ইপিআর বাহিনী এলাকাটি সকাল থেকেই ঘিরে যার জন্য জনসভা করা সম্ভব ছয় দফা প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ের সাফল্য গৌরব তেজগাঁও, পোস্ত গোলা, নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, আদমজীনগর করেনি।
প্রেস সেন্সরশিপের কারণে ঢাকায় সেদিন প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। তবে মওদুদ আহমদ তাঁর ‘কনস্টিটিউশনাল কুয়েস্ট ফর অটোনমি গ্রন্থে (পৃ. ৯৮) উল্লেখ করেছেন, সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৪১ এবং বন্দির সংখ্যা ১ হাজার ।
৭ জুনের আন্দোলন যে কত তীব্র ছিল তার আভাস পাওয়া যায় সেদিন প্রকাশিত সরকারি প্রেসনোট থেকে (বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ২য় খ- পৃ. ২৭০) যা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত (সরকারি প্রেস নোট)
ঢাকা ৭ জুন, আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহূত হরতাল ৭-৬-১৯৬৬ তারিখে প্রতিপ্রত্যুষ হইতে পথচারী ও যানবাহনের ব্যাপক ধারা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ছোকরা ও গুপ্তাদের লেলিয়ে দেয়া হয়। ইপিআরটিসি বাসে ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয় এবং টায়ারের পাম্প ছাড়িয়া দিয়া সর্বপ্রকার যানবাহনের অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। নিরীহ জনসাধারণ ও অফিসযাত্রীদের অপমান ও হয়রানি করা হয়। হাইকোর্টের সম্মুখে তিনটি গাড়ি পোড়াইয়া দেওয়া হয়। পুলিশ কার্জন হল, বাহাদুরশাহ পার্ক ও কাওরান বাজারের নিকট গুণ্ডাদের বাধা দান করে এবং টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করিয়া তাহাদের ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়।

তেজগাঁও দুই-ডাউন চট্টগ্রাম মেইল তেজগাঁও রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালে আটক করিয়া লাইনচ্যুত করা হয়। ট্রেনখানা প্রহরা দানের জন্য একদল পুলিশ দ্রুত তথায় গমন করে। জনতা তাদের ঘিরিয়া ফেলে এবং তুমুলভাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে, ফলে বহু পুলিশ কর্মচারী আহত হয়। যখন পুলিশ জনতার কবলে পড়িয়া যাবার উপক্রম হয়, তখন আত্মরক্ষার জন্য তাহারা গুলিবর্ষণ করে। ফলে ৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়
নারায়ণগঞ্জের এক উশৃঙ্খল জনতা সকাল ৬-৩০ মিনিটের সময় গলাচিপা রেলওয়ে ক্রসিংয়ের ঢাকাগামী ট্রেন আটক করে। পরে জনতা নারায়ণগঞ্জগামী ৩৪নং ডাউন ট্রেন আটকাইয়া উহার বিপুল ক্ষতিসাধন ও ড্রাইভারকে প্রহার করে। জনতা জোর করিয়া যাত্রীদের নামাইয়া দেয়। যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য আগত পুলিশদল আক্রান্ত এবং বহুসংখ্যক পুলিশ কর্মচারী আহত হয় । পুলিশদল লাটিচার্জের সাহায্যে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
অতঃপর বন্দুকসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে এক জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করে দারুণ ক্ষতিসাধন এবং বন্দুকের গুলিতে পুলিশ অফিসারদের জখম করে। উশৃঙ্খল জনতা থানাভবনে প্রবেশ করার পর পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করার ফলে ছয় ব্যক্তি নিহত ও বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা -৯ আরও ১৩ ব্যক্তি আহত হয়। ৪৫ জন পুলিশ আহত হয় এবং তাহাদের মধ্যে কয়েকজনের আঘাত গুরুতর। …টঙ্গীতে বিভিন্ন মিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে এবং একটি মিছিল বাহির করে।… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণির ছাত্র পিকেটিং করে এবং সেখানে আংশিক ধর্মঘট পালিত হয়।
দুপুরে আদমজী, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকগণ ১৪৪ ধারা লংঘন করিয়া শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। ঢাকা নগরীর দুই মাইল দূরে ইপিআর বাহিনীর একটি দল শোভাযাত্রার গতিরোধ করে। অপরাহ্নে এক জনতা গেন্ডারিয়ার কাছে একখানা ট্রেন আটক করে, চট্টগ্রামগামী গ্রিন-এ্যারো ও ঢাকা অভিমুখী ৩৩-আপ টেনখানিকে অপরাহ্নের দিকে তেজগাঁও স্টেশনে আটক করা হয়।
… সন্ধ্যার পর একটি উচ্ছৃঙ্খল জনতা কালেক্টরেট ও পরে স্টেট ব্যাংক আক্রমণ করে। রক্ষীগণ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলিবর্ষণ করে। বেলা ১১টায় ৫ বা ততোধিক ব্যক্তির একত্র সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়া ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরের অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিল।

৭ জুন দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত খবরে মোনায়েম খান পূর্বরাত্রে দমননীতির সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার যে উস্কানি দেন তার নিন্দা করে বলা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি এ ধরনের উস্কানি যারা দেয় তারা দেশ ও জনগণের শত্রু।’
৭ জুন পুলিশের গুলিবর্ষণসংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব বাতিলের প্রতিবাদে ৮ জুন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় সদস্যরা উভয় পরিষদকক্ষ বর্জন করে। ৭ জুন দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এতদসংক্রান্ত সংবাদ নিম্নরূপ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ২য় খণ্ড পৃ. ২৭৬) ‘রাওয়ালপিন্ডি, ৮ জুন (এপিপি : অদ্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বিরোধী দল কর্তৃক উত্থাপিত পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের গুলিবর্ষণসংক্রান্ত তিনটি মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার আবদুল জব্বার খান বাতিল করায় উহার প্রতিবাদে বিরোধীদলীয় সদস্যগণ পরিষদকক্ষ বর্জন করেন। স্পিকার তাহার চেম্বারেই মুলতবি প্রস্তাব তিনটি অগ্রাহ্য করেন।
মওলানা ভাসানী প্রথম থেকেই ৬ দফার বিরোধিতা করে আসছিলেন। ৭ এপ্রিল ৬৬ তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘ছয় দফা ‘সিআইএ’-এর দলিল এবং এতে অর্থনৈতিক মুক্তির ঘোষণা তথা সমাজতন্ত্রের কথা নেই, তাই তারা তা সমর্থন করবেন না।
ছ’দফাকে নস্যাত করার লক্ষ্যে তিনি ২১ দফার মতো ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন ৫ জুন ৬৬ অর্থাৎ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে প্রথম হরতাল (৭ জুন ‘৬৬) কর্মসূচীর ২ দিন পূর্বে। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পূর্বে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি।
উলেখ্য, ১৯৬৬ সনের শেষ দিকে ন্যাপের দু’জন প্রভাবশালী নেতা- যার মধ্যে তোয়াহা সাহেবের হুলিয়া ছিল অপরজন যাদু মিঞা তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান জেনারেল আওয়ানের সঙ্গে কক্সবাজারে মিলিত হয়েছিলেন উদ্দেশ্য ৬-দফার বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচী প্রণয়ন এবং মওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় লালিত ১২ জন বামপন্থী নেতার হুলিয়া প্রত্যাহার। একমাত্র মণি সিং বাদে সবাইর হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৬৮ সালে বাজেট অধিবেশনে (যখন বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলার আসামি) ন্যাপ দলীয় সংসদসদস্য মশিউর রহমান যাদু মিয়া (পরে জিয়ার সিনিয়র মন্ত্রী) জাতীয় পরিষদে বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতায় থাকলে দু’দফা দাবি তোলার অপরাধে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিতাম ।
ঐতিহাসিক ৭ জুন (‘৬৬) সর্বাত্মক হরতাল পালনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় যে আইয়ুব খান শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে হত্যার চেষ্টায় লিপ্ত হন আগরতলা মামলা দিয়ে, কিন্তু গণআন্দোলনে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। মুজিব হন বঙ্গবন্ধু আর আইয়ুব হন বিদায়। পরের ইতিহাস একদফা-স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন:
