৭ জুন ১৯৬৬ : স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিন – অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

৭ জুন ১৯৬৬ : স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিন – অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : পশ্চিমা জগতে এই বিশ্বাস দৃঢ় যে তেরো সংখ্যাটি হলো দুর্ভাগ্যের প্রতীক আর সাত সংখ্যাটি সৌভাগ্যের প্রতীক। কাকতালীয়ভাবে বাঙালিজীবনে সাত সংখ্যাটাই সৌভাগ্যের বাহন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রথমেই ১৯৫২ সাল দিয়ে শুরু করা যাক। এই সম্পর্কে সকলের কমবেশি জ্ঞান আছে। এর মধ্যে ৫+২=০৭ সংখ্যাটি পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি বাঙালির মুক্তির অন্বেষার প্রথম সোপানটি বাঙালিরা ৫২ সালেই অতিক্রম করে।

৭ জুন ১৯৬৬ : স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিন - অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

এরপর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরের কথা। পাকিস্তানের সেদিনের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সেনাশাসন জারির মাধ্যমে সারাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই ৭ অক্টোবরকে অনেকে ‘সমাপ্তির শুরুটা’ বলে মন্তব্য করে বস্তুত আইয়ুব খানের সেনা শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বাঙালির স্বাধিকার ও রাষ্ট্রচিন্তা সৃষ্টি করে। এই আইয়ুব খানের শাসনামলে তাঁরই সুবেদার মোনেম খান পাকিস্তানিদের পদলেহনের চূড়ান্ত রেকর্ড সৃষ্টি করেন।

[ ৭ জুন ১৯৬৬ : স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিন – অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ]

এই সময় আইয়ুব খান গণতন্ত্রকে মৌলিকতা দিয়ে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের মধ্যকার শ্বাসরুদ্ধকর দুটো ঘটনার একটি হলো পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষ, কাশ্মীর ও পশ্চিম রণাঙ্গনে সশস্ত্র সংঘাত। সেদিন পাকিস্তানের পূর্বপাশ সম্পূর্ণ অরক্ষিতই ছিল। কারও কারও ধারণা, ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান কাশ্মীরের আরও কিছু অংশ কব্জা করতে পারলে তারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের কাছে ছেড়ে দিয়ে একটা মীমাংসায় আসত।

অপর ঘটনাটি হচ্ছে শেখ মুজিব কর্তৃক ৬-দফা প্রস্তাব পেশ এই ৬-দফায় গণতন্ত্রের কথা ছিল; স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল; একই দেশে দুটো কারেন্সি বা দু’কেন্দ্ৰীয় ব্যাংকের কথা ছিল, যার যার বৈদেশিক মুদ্রা তার তার নিয়ন্ত্রণে ও ব্যবহারের বিধান রাখার কথা ছিল । আর ছিল যে কোনো একটি বাহিনীর প্রধান কার্যালয় পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের সুস্পষ্ট দাবি ও এক লাখের মতো একটি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রস্তাব। এইসব প্রস্তাবের শেষ কথা যে ছিল স্বাধীনতা, তা জানত বলে পাকিস্তানিরা ৬-দফাকে মূলে নির্মূলের পদক্ষেপ নিয়েছিল।

শেষ মুজিবের নিজের দলের বিভক্তি, প্রদেশ ও কেন্দ্রে শিখণ্ডি দাঁড় করিয়ে কিংবা অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করে এই দাবিগুলোকে চোখের অন্তরালে ও অস্তাচলে ঠেলে দেবার প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টা ছিল। এমন কি ৬-দফাকে সিআইএ-র পরিকল্পনা ও কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিপক্ষ বলেও প্রচার করা হলো। এত সবের পরও শেখ মুজিব ও তাঁর দল দমে না যাওয়াতে শেষপর্যন্ত আইয়ুব ও মোনায়েম জেলজুলুম ও নির্যাতনের পথ গ্রহণ করেন। সুবেদার মোনায়েম খান ঘোষণা দেন—তিনি যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন শেখ মুজিবকে জেলের অভ্যন্তরে থাকতে হবে।

১৯৬৬ সালের প্রথম ভাগে লাহোরে ৬-দফা ঘোষিত হয়। শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এসে পার্টি কংগ্রেসে ৬-দফাকে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ বলে ঘোষণা দিয়ে তা পাস করিয়ে নেন। তার পর থেকেই শুরু হয় জেলজুলুম, হাজতবাস, একের পর এক গ্রেফতার, মুক্তি আর গ্রেফতার, আবার হাজতবাস, মুক্তি, আর গ্রেফতার। দেশের এক প্রাপ্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত এই হয়রানি ও নির্যাতনের স্টিমরোলার চলতেই থাকে। এতসবের পরও শেখ মুজিব আরও অটল রইলেন। তবে একটি সীমাহীন শঙ্কাও সবাইকে পেয়ে বসল। শেখ মুজিব যে গল্পটি দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের বিতর্কটাকে জনপ্রিয় করেছিলেন তা নিম্নরূপ :

‘এক বাবার দুই সন্তানের মধ্যে একটা ছিল বোকা আর একটা ছিল চরম ধুরন্ধর। মৃত্যুকালে বাবা দুই সন্তানের জন্য একটি কাঁথা, একটি গাভী ও একটি খেজুর গাছ রেখে যান। বাবার ইচ্ছা ছিল দু’ভাই সমানভাবে এই সম্পদগুলো ভোগ করবে। বাবার মৃত্যুর পর ধুরন্ধর ভাইটি এই সীমিত সম্পদের এমনভাবে ভাগাভাগি করল যে বোকা ভাইটি পেল গাভীর মুখ, খেজুর গাছের গোড়া আর দিনের বেলা কাঁথা রাখার অধিকার।

ফলশ্রুতিতে বোকা ভাইটি না পেল গাভীর বিন্দুমাত্র দুধ, না পেল খেজুরের সামান্য রস, না শীতের রাতে কাথার সামান্য আরাম। দিন যেতে লাগলে বোকা ভাইটি চালাক হতে লাগল। সে তার ন্যায্য হিস্যা দাবি করল এবং ব্যর্থ হয়ে প্রথমে গাভীর মুখ বেঁধে রাখল, তারপর খেজুর গাছের গোড়ায় কাঁটা বিছিয়ে দিল এবং দিনের বেলা কাঁথাটি ভিজিয়ে রাখতে শুরু করল। এরপর কী হলো না বলেই শেখ মুজিব বলতেন দেখেন কী হয়? তা না হলে যে আরও চালাক হতে হবে।’

যখন দেখা গেল সারাদেশ প্রায় জেগে উঠছে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে তখন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিবকে স্থায়ীভাবে ১৯৬৬ সালের মে মাসে কারাগারে নিক্ষেপ করে। একই সঙ্গে ব্যাপক হারে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জেলে পুরে ফেলা হলো।

এমন একটি মুহূর্তে শেষ ভরসা হিসেবে শেখ মুজিব গোপনে ও কৌশলে জেলে থেকেই ছাত্র ও যুব নেতাদের প্রতিবাদের নির্দেশ দিলেন। বিস্তারিত প্রস্তুতির পর ৭ জুন সারাদেশে হরতাল আহ্বান করা হলো। ব্যাপকসংখ্যায় ছাত্ররা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলেও যুব ও শ্রমিকনেতৃত্বের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। বস্তুত শ্রমিক আন্দোলনকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ছিলেন আইয়ুবদের সপক্ষে আর ৬ দফার বিপক্ষে কিন্তু ৭ জুনের কতিপয় ঘটনায় বিশেষত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া একজন শ্রমিককে প্রকাশ্যে গুলি করায় তেজগাঁওয়ের শ্রমিকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের বিদ্রোহের খবর না জেনেও সারাদেশে বহু জায়গায় ছাত্র-শ্রমিকরা স্বউদ্যোগে প্রবল আঘাত হানে এবং সারাদেশ সম্পূর্ণ অকেজো করে দেয়।

এ দেশে এ ধরনের হরতাল আগে কেউ কখনও দেখেনি। এই দিন মনু মিয়া, আবুলসহ সারাদেশে কমপক্ষে ১১ শ্রমিক জনতা নিহত হয়। সেদিন বহু জায়গায় বহু গ্রেফতার ও হত্যার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্র নেতারা বিকালে কার্জন হলে বসে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। কার্যত আর একটি সাত সংখ্যাই বাঙালির স্বাধীনতায় উত্তরণে আরেকটি সোপান তৈরি করে। তারপর ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত ঘোষণা ও আহ্বান, ২৫ মার্চ রাতে (যোগফলটা ৭) স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১৬ (যোগফল ৭) ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জন মনে হচ্ছে সবই ৭-এর খেলা ।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment