৭ জুন স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করে – নূরে আলম সিদ্দিকী : ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পদক আব্দুর রাজ্জাককে ডেকে তাদের হাতে ৬-দফার একটি খসড়া তুলে দিয়ে মুজিব ভাই বললেন, এটি মূলত জাতির মুক্তিসনদ। আমি ছাত্রলীগের হাতে এই মুক্তিসনদ তুলে দিলাম। সেদিন অকুতোভয়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব গ্রহণ না করলে ৬-দফা আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করত, আলোর মুখ আর দেখত না।
ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে থাকে। ৬-দফা প্রদানের পরপরই মুজিব ভাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকেন। কাউন্সিলে ৬-দফা অনুমোদিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে মুজিব ভাই সভাপতি নির্বাচিত হন। তবু ৬ দফাকে বাংলার মানুষের মননশীলতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার মূল শক্তি ও প্রতীতির জায়গা ছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু মুজিব ভাই বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমা সফর করার সিদ্ধান্ত নেন; সেটিও সফল করার দায়িত্ব নেয় ছাত্রলীগ।
[ ৭ জুন স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করে – নূরে আলম সিদ্দিকী ]
কয়েকটি মহকুমা শহরে সভা করার পর জেলাভিত্তিক সভা করার পরই যশোরে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। জামিন পেলে আবার খুলনায় গ্রেপ্তার করা হলো, আবার মুক্তি পেলেন। এভাবে গ্রেপ্তার ও জামিনে আলো-আঁধারের খেলা চলতে চলতে সরকার সিদ্ধান্ত নিল ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলসে তাকে কারারুদ্ধ করার, যেখানে জামিনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মুজিব ভাই ও তার সহকর্মীসহ রাজবন্দিরে মুক্তি এবং ৬-দফাকে জাতীয় কর্মসূচিতে রূপদানের আঙ্গিকে ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী পূর্ণদিবস হরতাল আহ্বান করা হয়।
ইতিমধ্যে মানিক ভাইও ৬ দফার প্রতি তার সমর্থন ও প্রতীতি ঘোষণা করেন (এই সমর্থন আদায়ে শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও সৈয়দ মাযহারুল হক বাকীর অদম্য প্রচেষ্টার সঙ্গে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম)। একদিকে ইত্তেফাক, অন্যদিকে ছাত্রলীগ (তখনো আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতৃত্বের মধ্যে ৬-দফার পক্ষে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম হয়নি) ৭ জুনের হরতালের পক্ষে সূদৃঢ় অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতৃত্বের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খানসহ ছাত্রলীগের অসংখ্য প্রাক্তন নেতৃত্ব ৭ জুন সফল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এসে অবস্থান নেন। তখন আমাদের সামনে ঘনঘোর অমানিশা। এনএসএফ থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নসহ ডান-বাম সব সংগঠনই ৬-নকাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের ঘোরতর বিরোধী।
তখনো শ্রমিক লীগের জন্ম হয়নি। কিন্তু শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে ৭ জুন হরতাল পালন অসম্ভব ও অবাস্তব ছিল। সর্বজনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী, কামরুজ্জামান টুকু, ফিরোজ নূন ও আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে তেজগাঁও এলাকাকে হরতালের পক্ষে সংগঠিত করার। তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রসংসদের সহসভাপতি রহমত উল্লাহ আমাদের সাথে যোগ দেন। আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ স্থানীয় প্রভাবশালী শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ভূঁইয়ার (তার বাড়ি নোয়াখালী) সমর্থন কিছুটা আদায় করতে সক্ষম হন।
৩ তারিখ থেকে ৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত ৩০০-৪০০ লোক প্রতিশ্রুতি দিলেন তারা সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। আমরা তখন মনু মিয়াকে চিনতাম না। ৭ জুন ভোর থেকে শত চেষ্টা করেও একটা কার্যকর মিছিল বের করা সম্ভব হয়নি। যেটুকু হয়েছিল, সেটাকে ঝটিকা মিছিল বলাই বাঞ্ছনীয়। প্রকাশ্যে মিছিল করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা কয়েক জন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ৭ জুন সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী এক্সপ্রেস ট্রেনটির গতি রোধ করে দেব।
তখন আমার নিজের মধ্যে একটা নেশা ধরেছিল, যেকোনো উপায়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। সংখ্যায় আমারা ২৫-৩০ জন হব। প্রচণ্ড আবেগে আমরা রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ে রেলের গতি রোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই আঙ্গিকে আমি অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্য দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে উত্তেজক বক্তৃতা করছিলাম। সেই খবর কোনোভাবে পুলিশের কাছে পৌঁছেছিল বিধায় তারা স্বতন্ত্র একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে ১০-১৫ জন পুলিশ পাইলটিং করে আগলে নিয়ে এগোচ্ছিল ঐ এলাকা পার করে দেওয়ার জন্য।
আমাদের কাছাকাছি এসে পুলিশভর্তি ইঞ্জিনটি থেকে একজন গুলি ছোড়ে (সেদিন নারায়ণগঞ্জ ও সদরঘাটেও গুলি হয়েছিল)। যে দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে আমি বক্তৃতা করছিলাম, তাদের একজন মাটিতে পড়ে গেলেন; তিনিই মনু মিয়া। তাকে সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁওয়ের একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলেম। তখন তিনি জীবিত এবং জ্ঞান রয়েছে।
বিন্দুমাত্র চিকিৎসা তার শুরু হয়নি, আমার কোলে মাথা রেখে মনু মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, ‘মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা হলে বলবেন, আমি ৬-দফার জন্য জীবন দিয়ে গেলাম।’ তেজগাঁও রেলগেটের কাছে পুলিশ আমাদের কাছ থেকে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ধস্তাধস্তিতে আমার শার্ট ছিঁড়ে গেছে, মনু মিয়ার রক্তে আমার শরীর ভিজে গেছে। মনু মিয়ার রক্তাক্ত গেঞ্জিটি আমি হাতছাড়া হতে দিইনি।
ঐ গেঞ্জি একটি লাঠির মাথয় বেঁধে সেটিকে উড্ডীয়মান রেখে জঙ্গিমিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোতে থাকলাম। মনু মিয়ার রক্তে ভেজা গেঞ্জি নিয়ে সেই মিছিল শুধু রাতারাতি আমাকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত করেনি, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রেক্ষাপটে এই জীবনসায়াহ্নে এসে আজও আমি পুলকিত বোধ করি। গর্ব, আনন্দ আজও আমার সমগ্র সত্তাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।
উৎস : ইত্তেফাক, ০৭/৬/২০২০
আরও পড়ুন: