৬ দফা বাঙালির মুক্তিসনদ – ড. আনু মাহমুদ : পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদের প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ৬-দফা পেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও শাসকমহলসহ সারা পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
লাহোরে পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী দলের সভায় ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৬-দফা পেশ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ ছিল ৬-দফা। এর ফলে বাঙালির মুক্তিআন্দোলন নতুন করে গতি পায়। আসল সত্য হলো, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যে ৬-দফা প্রণীত হয়নি। একদেশে দুটি স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবহার প্রস্তাব করে শেষ মুজিব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, অন্য কিছু নয়, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
[ ৬ দফা বাঙালির মুক্তিসনদ – ড. আনু মাহমুদ ]
বঙ্গবন্ধু লাহোরে পৌঁছানোর আগে মুসলিম লীগ নেতা খান আব্দুল কাইয়ুম খান এক জনসভায় তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন, ৬-দফা দিয়ে পাকিস্তানের অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করলে তিনি রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবেন। কাইয়ুম খানের ঐ চ্যালেঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং লাহোরে গিয়ে সফল জনসভা করেন ।
শেখ মুজিব ১১ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) ঢাকা ফিরে আসেন। ঐ দিনই তাঁর বাসভবনে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে তিনি বলেন, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্কে তিনি হতাশ। ৬-দফার আদর্শ বাস্তবায়ন করা তাঁদের দিয়ে সম্ভব হবে না। তাই তিনি তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হিসেবে প্রতিটি জেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রনেতাদের আদেশ দেন।
৬-দফা ঘোষণার পর এর সমর্থনে এবং বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে ৭ জুন (১৯৬৬) পূর্ব-পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতালের সফলতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ৬-দফার ব্যাপারে জনগণের আস্থা অর্জন করে । শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-জনতার সফল হরতাল আইয়ুব সরকারকে কাঁপিয়ে তোলে।
এই হরতালের খবর দৈনিক ইত্তেফাকে ফলাও করে ছাপা হয়। সেই কারণে ১৬ জুন (১৯৬৬) ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয় ও ১৭ জুন (১৯৬৬) ইত্তেফাককে নিষিদ্ধ করা হয় (পাকিস্তান অবজারভার, ১৮ জুন, ১৯৬৬)।
১৯৬৭ সালের ২৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ময়মনসিংহে এক জনসভায় বলেন, ‘যারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্যে চেঁচামেচি করছে তারা পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা কামনা করে যদি এটা ঘটে, তাহলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। (দৈনিক আজাদ ৩১ মার্চ, ১৯৬৭)। ৬-দফার বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে আবদুস সালাম খান, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও খন্দকার মোশতাক পাল্টা গ্রুপ গঠন করেন ।
রংপুরে ন্যাপের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ৩০ নভেম্বর (১৯৬৭)। এতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বকেই ৬-দফা নামের স্বায়ত্তশাসনের ‘লেবাস’ পরাইয়া হাজির করানো হইয়াছে। অবাঙালি আদমজী, দাউদের স্থলে কয়েকজন বাঙালি আদমজী-দাউদ সৃষ্টিই যদি ৬-দফার লক্ষ্য হইয়া থাকে, তবে স্বায়ত্তশাসনের নামে বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষ কোনোদিনই তার জন্য বুকের রক্ত ঢালিতে যাইবে না।
কেননা, যে ৬-দফা কর্মসূচিতে বাংলার কৃষক-শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের অধিকারের কোনো স্বীকৃতি নাই, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অনিবার্যভাবেই শোষণ-পীড়ন চালাইবার অধিকারে পর্যবসিত হইবে। (স্বাধীনতার দলিল : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৩)।
বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬-দফা :
১। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি : দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনই হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে ফেডারেল ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদে নির্বাচিত হবে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা : কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যথা : দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ ।
৩। মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা : মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত যে কোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে ।
(ক) সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময় মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা
(খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবলমাত্র একটি মুদ্রা চালু থাকতে পারে।
তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব
পাকিস্তানের জন্যে পৃথক আর্থিক ও অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে ৪। রাজস্ব কর ও শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা: ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনোরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয়নির্বাহের জন্যে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সবরকম করের ক্ষমতা শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ
নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে ৫। বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা :
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসেব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনো বাধানিষেধ থাকবে না ।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি
প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৬। আঞ্চলিক বাহিনীর গঠন ক্ষমতা : আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্যে শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। (শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঁচার দাবি, ৬-দফা কর্মসূচি; (প্রকাশ-আবদুল মোমেন, প্রচার সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ারী লীগ থেকে সারসংক্ষেপ)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক ৬-দফা ঘোষণার পর গোটা পূর্ব-পাকিস্তানে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে দেখে জেনারেল আইয়ুব খান দিশেহারা হয়ে যান। উপায়ন্তর না দেখে নতুন যড়যন্ত্র শুরু করেন। তারই পটভূমি হিসেবে ১৯৬৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনায় এক জনসভায় আইয়ুব খান ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ বিচ্ছিন্নতাবাদী। (দৈনিক পাকিস্তান, ১ জানুয়ারি, ১৯৬৮)।
তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জানুয়ারির (১৯৬৮) প্রথম সপ্তাহে বলে, পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করার একটি চেষ্টা সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। এর সাথে জড়িত বাঙালি সৈনিক, সেনা অফিসার এবং এ.এস.পি অফিসারসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
শেখ মুজিবকে এই পরিকল্পনার মূল নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রাওয়ালপিণ্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সিভিল সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্যসহ ২৮ জন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১টায় (অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে আবার কারাগারের গেট থেকেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উপলক্ষে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮ জানুয়ারি (১৯৬৮) সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও পরিচালনার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজেই অন্যান্যদের সাথে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তিনি পূর্ব থেকেই জেলে ছিলেন।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ জানুয়ারি, ১৯৬৮)।
তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে, বিচারপতি মকসুমুল হাকিমসহ কয়েকজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত একটি ট্রাইব্যুনালে। সে দিনই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ চার্জশিট দাখিল করা হয়।
চার্জশিটের সঙ্গে ‘দলিলপত্র’ নামে যেসব কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছিল, তাতে ‘আলো, ‘এস’ ছদ্মনামের বেশকিছু চিঠি, ‘বাংলাদেশ,’ ‘বেতারবাণী’ ‘বেঙ্গল এয়ার ফোর্স’ শব্দবিশিষ্ট কয়েক টুকরো কাগজ, পূর্ব পাকিস্তানের ভাঁজ করা একটি মানচিত্র, নোয়ার আলী নামের একজন মোটরচালকের চরিত্রসনদ, ঢাকা দাউদকান্দি ফেরিঘাটের লগ বই, শেখ মুজিবের ব্যাংক একাউন্টের হিসাবনিকাশ ইত্যাদি আদালতে পেশ করা হয়। (স্বাধীনতার দলিল : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০২)।
আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে এবং নিজেকে ‘নিরপরাধ’ দাবি করে বঙ্গবন্ধু আদালতে বলেন : ‘১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যেসব রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম।… যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি।
সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ, যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ বহির্বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।… ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারি নেতৃবৃন্দ ও সরকারি প্রশাসনযন্ত্র আমাকে ‘অস্ত্রের ভাষায়’, ‘গৃহযুদ্ধ’ ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযোগে এক ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে।
… ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমতার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা ও নিষ্পেশন করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।… এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির সহিত কোনো আলোচনা আমার অথবা তাজউদ্দিনের বাসায় সংঘটিত হয় নাই।
একজন প্রাক্তনমন্ত্রী হিসেবে অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্বরাষ্ট্র বিভাগের উক্ত প্রচারপত্র সম্বন্ধে একথা জানাইতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিব কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিলপত্র পরীক্ষিত ও অনুমোদিত হওয়া ব্যতিরেকে কোনো বিভাগ হইতে কোনো প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায় না।’ (মুক্তিযুদ্ধের দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৯)।
এ বিচার যে প্রহসন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার ষড়যন্ত্র এটা বাঙালিদের টের পেতে মোটেও কষ্ট হয়নি। সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করার পর বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের আশঙ্কা আরো ঘনীভূত হয় যে, স্বৈরাচারী জেনারেল আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে অবশ্যই হত্যা করবে। ঐ সময় বাঙালির মুক্তির দূত শেখ মুজিবকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জনসাধারণ রাজপথে নেমে আসে। সান্ধ্য আইন জারি করেও আইয়ুবশাহী ব্যর্থ হয় ক্ষুব্ধ বাঙালিদের স্তব্ধ করতে ।
ঐ সময়ে জেনারেল আইয়ুবের এদেশীয় দোসর ও মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় বাঙালিরা। অবস্থা বেসামাল দেখে তা সামাল দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্য কামনা করেন। তখন আওয়ামী লীগসহ সকল দলের পক্ষ থেকে শর্ত দেয়া হলো, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে।
তারপরই কেবল ভেবে দেখা হবে আইয়ুবের আহ্বানে সাড়া দেয়া হবে কিনা। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলোর এই শর্তকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত সমর্থন করে। নিরুপায় হয়ে আইয়ুব খান তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্নে গোটা বাঙালি জাতি আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে। অবস্থান নেয়। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে যারা নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে চান তাঁদের পক্ষে আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর পথ বাদ দিয়ে অন্য কোনো পথে চলা ছিল অসম্ভব। যে কারণে মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খানসহ অনেকে আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির পক্ষে এবং ৬-দফা আন্দোলনের পক্ষে কেবল সমর্থনই নয়, রাজপথে ছাত্র-জনতার প্রাণচঞ্চল আন্দোলনে শরিক হতে হয়েছে ।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ৬-দফা পরিকল্পনা পেশ করার সময় শেখ মুজিব তাঁকে এবং রহুল কুদ্দুসকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আসলে এটা ৬-দফা নয়, এক দফাই, ঘুরিয়ে বললাম শুধু
ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি পরিবারের বড়ো মেয়ে হিসেবে বাবাকে তখন খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। যদিও আজ (১৯৮৫ সাল) থেকে ২০ বছর আগের কথা তবুও মনে হয় স্পষ্ট দেখছি বাবাকে । খাবার টেবিলে যদি আমরা বাবাসহ খেতে বসেছি, কিংবা দুর্লভ সব মুহূর্তে বাবাকে ঘিরে বসে গল্প শুনছি, গল্প করছি তখন হঠাৎ বাবা বলতেন, এখন চুপ; বলো তো কী আমাদের প্রতিজ্ঞা? আমরা ট্রেনিংপ্রাপ্তের মতো পটপট ছ’আঙুল তুলে বসে থাকতাম। বাবা খুশি হতেন।
হ্যাঁ, এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা। বাবার সংগ্রামে শরিক হয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাবা যখন খাবার টেবিলে খেতে বসতেন বা কথা বলতেন, তখন ছ’আঙুল তুলেই পাঁচ আঙুল সরিয়ে নিয়ে তিনি বলতেন, এখন শুধু এক দফা।” (সচিত্র সন্ধানী’-র সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ১৯৮৫)।
৬-দফা প্রণয়ন সম্পর্কে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও সরকারি অফিসার ৬-দফার কয়েকটি দফা তৈরি করেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন শেখ মুবিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু।
তাঁরই অনুরোধে রচিত ৪-দফার খসড়াটি তাঁকে দেখান। তিনি সি.এস.পি অফিসার রহুল কুদ্দুসকে বলেন, আমাদের এই খসড়ার দাবিতে বাংলাদেশের জন্য আলাদা প্যারা-মিলিশিয়া কথাটা যোগ করতে হবে। তাছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা-ব্যবস্থার কথা বলা দরকার।
“কয়েকদিন পর মানিক মিয়ার ধানমণ্ডির বাসায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দাবি নিয়ে মধ্যরাতে গোপন বৈঠক বসে। এই বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান ও মানিক মিয়া ছাড়াও নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, মোহন মিয়া, নান্না মিয়া উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ৬-দফা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, নান্না মিয়া মোহন দাবিগুলোর বিরুদ্ধে মত করেন। অন্যরা সেই মুহূর্তে দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলনে নামার পক্ষে মত করেন।
শেখ মুজিব খসড়া প্রস্তাব আকারে দাবিগুলো কাগজে হয়েছিল সেটা তুলে নিয়ে বললেন, এই দাবিগুলো হচ্ছে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের ‘ম্যাগনাকটা’। দাবির আমরা অন্তত বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। আপনারা কেউ রাজি না তাহলে আমাকে একাই দাবি পেশ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে এবং কোনো দল চাইলেও আওয়ামী লীগকে নিয়েই আমাকে আন্দোলন নামতে হবে।’ (ধীরে বুড়িগঙ্গা, প্রথম পৃষ্ঠা ১৪৮-১৫১)।
আজকে স্বাধীনতা-বিরোধীচক্র প্রশ্ন তুলেছে ৬-দফা মূলত মুজিবের ক্ষমতা লাভের একটি অস্ত্র ছিল। সেখানে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। অথচ ইতিহাস বলছে, যারা সময়ের অবস্থা দেখেছে তারা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য পাকিস্তানিরা ৬-দফাকেই বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের এদেশীয় দোসররা বলেছে, ৬-দফা হচ্ছে পাকিস্তানকে ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। তখনকার পত্রিকাগুলোতে এখনো সেই প্রমাণ রয়ে গেছে। তারপরও আজকে পাকিস্তানিদের দেশীয় এজেন্টরা কৌশলে বলে বেড়াচ্ছে ৬-দফা বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে খুব বড়ো ভূমিকা পালন করেনি। আসলে সবই ঘৃণ্য মিথ্যাচার।
সূত্র : ড. মাহমুদ (স্বাধীনতার দলিল সংগৃহীত)
আরও পড়ুন: