৬-দফা ও ৭ই জুনের হরতাল – মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

৬-দফা ও ৭ই জুনের হরতাল – মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ১৮ বছর বয়সে আমি প্রথম জেলে গিয়েছিলাম। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন তারিখে । ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবিতে আওয়ামী লীগ সেদিন দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছিল।

আমি কখনই আওয়ামী লীগ করতাম না। আমি ছিলাম নিষিদ্ধ ঘোষিত ও ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থাকা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য।

৬-দফা ও ৭ই জুনের হরতাল - মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

আওয়ামী লীগের কর্মী না হয়েও সেদিন আমরা ৭ই জুনের হরতালের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম। আগের দিন কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছে নির্দেশনা চেয়েছিলাম ৭ই জুনের হরতালের দিন আমাদের করণীয় কি হবে? নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছিল ৬-দফা ‘মুক্তিসনদ’ নয়। তবে তা গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুতে ‘ন্যায্য দাবি’। এই দাবিতে মানুষ রাস্তায় নামলে ‘পরিপূর্ণ সাথে থাকতে হবে।’

[ ৬-দফা ও ৭ই জুনের হরতাল – মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ]

এই নির্দেশনা মেনে সে দিন সকাল সকাল রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম ঢাকা শহরে মোটামুটি স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কর্মীদের উপস্থিতি তেমন নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখানে-সেখানে পিকেটিং করছে। রাস্তার পাশে জটলা করে হরতালের পক্ষে কথাবার্তা বলছে। ছাত্র ইউনিয়নের মিটু, সিরাজীসহ আমরা কয়েকজন জনগণের সাথে মিলে স্টেডিয়াম গেইটের সামনের রাস্তায় পিকেটিংয়ে যোগ দিলাম।

মনোযোগ সেদিকে কেন্দ্রীভূত থাকায় টের পাইনি যে, কখন হঠাৎ মোড় ঘুরে পুলিশের গাড়ি আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একদল পুলিশ এসে মিটু, সিরাজী ও আমাকেসহ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষকে গ্রেফতার করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল।

আমাদেরকে সোজা নিয়ে আসা হলো রমনা থানায়। রমনা থানায় একটি ঘরে (গাদাগাদা অনেক পরিপূর্ণ) আমাদেরকে আটকে রাখা হলো। কিছুটা বেলা হওয়ার পর গারদ খুলে একজন একজন করে নেয়া হলো পাশের একটি রুমে। এক সময় আমাকেও নেয়া হলো সেই রুমে। ছোটখাটো ও হালকা পাতলা একজন মানুষকে দেখলাম। টেবিলের একপাশে বসে তিনি কাগজে একের পর এক কি যেন সব লিখে চলেছেন। আমার নাম ঠিকানা জানতে চাওয়া হলো, বললাম।

তারপর কোনো কথাবার্তা ছাড়াই আমাকে আবার ফিরিয়ে নেয়া হলো। জানলাম, যেখানে আমাকে নেয়া হয়েছিল সেটি একটি ‘মোবাইল সামারী কোর্ট’। আইউব-মোনায়েমের ধামাধরা বলে খ্যাত’ বখ্ত সাহেব নামের একজন ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় আমাকে ১ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে রায় দিয়েছেন। অনেকটা রাতে আমাকে এবং আমার মতো দণ্ডপ্রাপ্ত শ’খানেক বন্দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়া হলো।

রাতটা কোনো রকমে কাটালাম জেলখানার ‘আমদানি’ নামের বড় ওয়ার্ডে পরদিন ভোরে আমাদেরকে হাজির করা হলো ‘কেইস টেবিল’ (উচ্চারণে যাকে কয়েদি-হাজতিরা বলতো কে াফাইল’) নামের চত্বরে। আমাকে কয়েদির কার্ড লিখে দিয়ে পাঠানো হলো ৩ খাতার নিচতলায়। ৩ খাতায় স্থানান্তর হওয়া পর্যন্ত ‘কেস্টোফাইল’ চত্বরেই থাকতে হলো। এই চত্বরের একদিকে জেলাখানার রান্নাঘর (বা যাকে সবাই বলতো ‘চৌকা’)। তার বিপরীত দিকে দেওয়ানী, পুরান বিশ সেল, নতুন বিশ সেল ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি দেয়ালপরিবেষ্টিত এলাকা।

সেই এলাকায় প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি কাঠের দরজা। (১৯৭৬ সালে এখানে আমাকে লম্বা সময় ধরে রাখা হয়েছিল।) বেলা ১০টা থেকে ১১টার দিকে দেওয়ানী এলাকার দরজাটি খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ালেন পাইপ মুখে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ‘শেখ সাহেব’। মিনিটখানেকের জন্য দেখা দিয়ে তিনি আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিকেলে আমি চলে গেলাম ৩ খাতায়। দু’সপ্তাহ পর কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে জজকোর্টে আপিল করে জামিন পাওয়ায় সেবার আমার প্রথম কারাবাস তখনকার মতো সমাপ্ত হয়েছিল ।

যাই হোক! কারাস্মৃতির কথা লেখা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য ৬ দফা ও ৭ই জুনের হরতাল নিয়ে কিছু বিষয়ের অবতারণা করা। ৭ই জুনের ঐতিহাসিক হরতালের পেছনে মূল দাবিটি ছিল ৬-দফা ৷ ৬-দফা চমক সৃষ্টি করেছিল । কিন্তু এই দাবিনামার বিষয়বস্তু নতুন কিছু ছিল না।

অনেকের মাঝে এমন একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, ‘শেখ মুজিব’ ৬-দফা পেশ করার মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা উত্থাপন করেছিলেন । কথাটি সত্য নয়। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও তার স্পষ্ট রূপরেখা দালিলিকভাবে প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে। এই ২১-দফার ১৯নং দফাটি ছিল নিম্নরূপঃ

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল-বাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণকরণ : পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্রবাহিনীতে পরিণত করা হইবে।

যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় পূর্বঙ্গকে ‘স্বায়ত্তশাসন’ প্রদান ও ‘সার্বভৌমিক’ (!) করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিষয়গুলো কিভাবে কেন্দ্রীয় (পাকিস্তানি) সরকার ও পূর্ববঙ্গের সরকারের মধ্যে বণ্টন করা হবে তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল।

বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এই প্রস্ত বিনায় দেশরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গকে কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তাননির্ভরতা থেকে মুক্ত করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, সে বিষয়ে একটি স্পষ্ট পথনির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। বস্তুত ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে যে কাঠামোগত রূপরেখা বর্ণিত হয়েছিল তা অনুসরণ করে ১২ বছর পরে আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচি রচিত হয়েছিল ।

কমিউনিস্ট পার্টি আরো আগে, ১৯৪৭ সালে পার্টিশনের পরে পরেই, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়-লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ বলে শ্লোগান তুলেছিল। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যায়িত করে পাকিস্তানকে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র হিসেবে সে মূল্যায়ন করেছিল। এই কৃত্রিমতা চিরস্থায়ী হবে না বলেও সে বিশ্লেষণ করেছিল।

কমিউনিস্টদের সে সব তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, এ কথা যদি কেউ দাবি করেন যে, কমিউনিস্টরাই বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে সর্বপ্রথম সোচ্চার হয়েছিল, তাহলে তার সে কথা মোটেও ফেলে দেয়া যায় না। কিন্তু সে কথা বাদ দিলেও, একথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দালিলিকভাবে প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায়।

এ প্রসঙ্গে একথা অবশ্য সাথে সাথে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ২১-দফা রচনায় এদেশের কমিউনিস্টদের অবদান ছিল প্রধান। আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচিতে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় প্রদত্ত স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখাকে কতক ক্ষেত্রে আরেকটু স্পষ্ট করা হয়েছিল। বিশেষত মুদ্রা সম্পর্কে দু’টি বিকল্প প্রস্তাবনা এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে অতিরিক্ত কিছু ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। এ পর্যায়ে ৬-দফা কর্মসূচিটি অনেকটা পূর্ণাঙ্গভাবে উদ্ধৃত করা অপ্রাসঙ্গিক বা বাহুল্য হবে না।

আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি:

এক. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।

দুই. ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে। তিন. এই দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়। এর যে কোনো একটি গ্রহণের প্রস্তাব রাখা হয়

(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট ব্যাংক’ থাকিবে। (খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে।

এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে চার সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এইমর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে পাঁচ. এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয় :

১. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।

২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে ।

৩. ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।

৪. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি চলিবে।

৫. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রফতানি করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।

৬. এই দফায় পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়।

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, যুক্তফ্রন্টের ২১-দফার ধারাবাহিকতাতেই রচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের ৬-দফা । ৬-দফায় ছিল প্রধানত দু’টি ইস্যু ‘গণতন্ত্র’ ও ‘স্বায়ত্তশাসন’। ২১-দফায় ছিল গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের ইস্যু ছাড়াও অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক নানাবিধ ইস্যু।

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, বর্ধমান হাউজকে (যা তখন ছিল সরকারপ্রধানের বাসভবন) বাংলা ভাষার গবেষণাগারে রূপান্তরিত করা, শহীদমিনার নির্মাণ, শহীদ দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করা, দুর্নীতি রোধ করা, কালা-কানুনসমূহ বাতিল, বিচার বিভাগকে শাসন-বিভাগ থেকে পৃথক করা, আইন পরিষদের ব্যয় হ্রাস করা, জমিদারী প্রথার বিলোপ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, কৃষিতে সমবায় চালু, কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নয়ন, বন্যা ও দুর্ভিক্ষ রোধের ব্যবস্থা, শিল্প ও কৃষিতে স্বাবলম্বী হওয়া, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অতিরিক্ত এসব বিষয়গুলোও ২১-দফাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এসব বিষয়গুলো কিন্তু ৬-দফায় নেই। শুধু এই একটি যুক্তিতেই বলা যেতে পারে যে, ৬-দফা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ন্যায্য দাবিনামা হওয়া সত্ত্বেও তা সর্বাঙ্গীন ও পরিপূর্ণ একটি দাবিনামা নয়। সে কারণে এটিকে ন্যায্য দাবি বলে আখ্যায়িত করলেও তাকে ‘মুক্তিসনদ’ বলা যায় না।

১৯৬৬ সালে ৬-দফা দাবিনামা পর দেশে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য গণআন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠার পাশাপাশি শ্রমিক-কৃষকের অধিকার, ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবীদের ন্যায্য দাবি দাওয়া, আমূল ভূমিসংস্কার, ব্যাংক-বীমা-বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানো ইত্যাদি দাবিতে সংগ্রামগুলো জোরদার হয়ে ওঠে।

৬-দফার সাথে এসব দাবি-দাওয়া যোগ দিয়ে ১৯৬৯ সালে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ১১-দফা দাবিনামা উত্থাপিত হয়। এই ১১-দফাকে ভিত্তি করেই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান । ঘটে আইয়ুব শাহীর পতন। অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০-এর নির্বাচন। সেই নির্বাচনের রায় বানচাল করার বিরুদ্ধে শুরু প্রতিরোধ। ১৯৭১-এর ২৫ গণহত্যা শুরু গেলে প্রতিরোধ জনযুদ্ধে উত্তোরিত হয়। সূচিত বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।

সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাকে ধারণকারী তথা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্য নীতিকে অবলম্বন করে রচিত সংবিধানকেই কেবল মুক্তিসনদের’ সমূল্য একটি দলিল বলে আখ্যায়িত করা একথা ঠিক যে, ‘মুক্তিসনদ’ ছিল না। ৭ই হরতালও ছিল বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের প্রথম কর্মসূচি। তবে একই সাথে কথাও সত্য যে, ৬-দফা ও ৭ই জুনের নিঃসন্দেহে আমাদের মুক্তি-সংগ্রামের সুদীর্ঘ ‘ঐতিহাসিক উল্লম্ফনের’ মতো মাইলফলক।

আরও পড়ুন:

৬ দফা থেকে স্বাধীনতা – সেলিনা হোসেন

ছয় দফা আন্দোলন

Leave a Comment