৬ দফার তাৎপর্য – ডক্টর মো. আখতারুজ্জমান

৬ দফার তাৎপর্য ডক্টর মো. আখতারুজ্জমান : লাহোরে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি/১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বাসভবনে বিরোধী দল মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলামী, জামাত-ই-ইসলামী ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিক সম্মেলন করে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো, অর্থনৈতিক নীতিমালা ও বাংলার নিরাপত্তা বিষয়ে যে ছয়টি দাবি বা প্রস্তাব উত্থাপন করেন তা-ই ‘ঐতিহাসিক ছয় দফা নামে পরিচিত।

৬ দফার তাৎপর্য - ডক্টর মো. আখতারুজ্জমান

এর স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর প্রণেতাও তিনি। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছেন। হঠাৎ প্রণীত হয়নি এ ছয় দফা। ঐতিহাসিক পরিক্রমায় ছয় দফার উন্মেষ ঘটে। বিশেষ করে ১৯৪৭-এ পাকিস্ত ান সৃষ্টি থেকে শুরু করে ১৯৬৫ পর্যন্ত বাঙালি জাতি তথা বঙ্গবন্ধুর অর্জিত নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাত সংবলিত তিক্ত অভিজ্ঞতা ছয় দফা প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ, ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়েও পাকিস্তানি জান্তার ষড়যন্ত্রে তা অকার্যকর হওয়া, আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র, সামরিক শাসন ও সামরিক আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ববাংলার সম্পদ লুণ্ঠন ও বৈষম্যনীতি এবং সর্বোপরি ১৯৬৫-এ পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে পূর্ববাংলাকে কার্যত অরক্ষিত, নিরাপত্তাহীন ও ঝুঁকির মধ্যে রাখা আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ছয় দফা প্রণয়ন ও উত্থাপনের যৌক্তিক পটভূমি তৈরি করে দেয়।

[ ৬ দফার তাৎপর্য – ডক্টর মো. আখতারুজ্জমান ]

সংক্ষেপে ছয় দফা ছিল নিম্নরূপ:

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নপূর্বক পাকিস্তানকে ফেডারেশন-ভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা। সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। সকল প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত আইন সভাগুলো হবে সার্বভৌম।

২. যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে শুধু দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি । অবশিষ্ট সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. সমগ্র দেশের জন্য দু’টো পৃথক অথচ অবাধ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের। হাতে। (অথবা) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে, তবে শাসনতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন অর্থ পাচার হতে না পারে। এজন্য একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং দু’অঞ্চলের জন্য দু’টো পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

৪. সকল প্রকার রাজস্ব, কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা অঙ্গরাষ্ট্রের সরকারের হাতে থাকবে।

৫. বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রত থাকবে রাষ্ট্রগুলো যুক্তিযুক্ত হারে কেন্দ্রের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেবে।

৬. আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে আধাসামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা দিতে হবে।

স্পষ্টত দফাগুলোর মধ্যে তিনটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত, দুইটি শাসনকাঠামো ও রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিসংক্রান্ত আর একটি জাতীয় নিরাপত্তাসংশিষ্ট।

ছয় দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য পাকিস্তানিরা সম্ভবত উপলব্ধি করতে পেরেছিল। সেজন্য শুরুতে একে নস্যাৎ করার সকল পন্থা ও অপপ্রয়াস হাতে নেয় তারা। পাকিস্তানের আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আব্দুল হাই চৌধুরী করাচিতে এক সভায় ছয় দফাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা’ বলে আখ্যা দেয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবকে ‘বিচ্ছন্নতাবাদী’ হিসেবে রূপায়িত করে।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফাকে “হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেন। ছয় দফা সমর্থকদের ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারী’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি তাদের উচ্ছেদে প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন। মুসলিম লীগ, জামাত-ই ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলামী ছয় দফাকে ‘পাকিস্তান বিভক্তকারী’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি হিসেবে চিহ্নিত করে।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো একটু খোলাসা করে ছয় দফাকে দেশ বিভাগের ফর্মুলা আখ্যা দিয়ে বলেন,

The six point formula was meant to strike the roots of our nationhood. Initiallz it would have created two Pakistans, and later might well have brought five independent states into being.

ভুট্টোর ভাবনা মোতাবেক দু’টো পাকিস্তান বা পাঁচটি স্বাধীন রাষ্ট্র এখনও হয়ত জন্ম নেয়নি, তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হয়েছে।

ছয় দফাকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ, সংগ্রাম ও আন্দোলনে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক। ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ৬-দফা অনুমোদিত হয়। পরে ১৭-২০ মার্চ ১৯৬৬ ঢাকার ইডেন হোটেলে (নটরডেম কলেজের দক্ষিণ দিকে) অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তা চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ২৩ মার্চ থেকে ৮ মে ১৯৬৬ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল জেলা ও মহাকুমায় সফর করেন, জনসভা করেন এবং জনমত গঠন করে হয় দফার পক্ষে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন।

ঐতিহাসিক ছয় দফা ও তৎপরবর্তী ঘটনায় আওয়ামী লীগের গণসমর্থন ও সাফল্যের পেছনে কারণ কী? সংক্ষেপে বললে কারণ এই যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি আর্থসামাজিক বৈষম্যমূলকনীতি, অর্থ পাচার, পূর্ববাংলাকে নিরাপত্তাহীন রাখা, সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রে প্রবেশে বাঙালিদের সুযোগ না দেয়া, বাংলায় অতি প্রয়োজনীয় ন্যায্য উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ না করা, ভাষা সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রভৃতির একটি বস্তুনিষ্ঠ চিত্র আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনতার কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষার জন্য বাস্তবধর্মী দাবি ও চিত্র উত্থাপন করেছেন। পরিপূর্ণ ব্যাপক গণসমর্থন লাভ করেই বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে চূড়ান্ত যৌক্তিক পরিণতিতে পৌছাতে সক্ষম হন।

সমসাময়িক কালেও ছয় দফার অন্তর্নিহিত উপাদান সারাংশের সার্থক ব্যবহার ও সুফল প্রত্যক্ষ করা যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর পল্টন ময়দানে এক জনসভায় জামায়াত-বিএনপির চারদলীয় জোট সরকারের দুঃশাসন, দুর্নীতি ও জঙ্গি চরিত্রের চিত্র উত্থাপন করে যে ২৩ দফা ঘোষণা করেছিলেন তা ব্যাপক গণসমর্থন লাভ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী ইশতেহারে পরিপূর্ণ প্রত্যাশা মোতাবেক যে ‘রূপকল্প ২০২১’ (Vision ২০২১) ঘোষিত হয়েছিল তারই ফলশ্রুতিতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। মানুষকে সেদিন জননেত্রী আলোর পথ দেখিয়েছেন। আশার কথা শুনিয়েছেন।

দিনবদলের কথা বলেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জাতির জনকের সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর মানুষ তার প্রতি ব্যাপক আস্থা রেখেছে বস্তুত ছয় দফা প্রণয়ন ও এর সার্থক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিনব নেতৃত্ব ও কর্মকৌশলের পদ্ধতি, নৈতিক দর্শন ও প্রক্রিয়া জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে শিখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত এ কর্মপন্থা ও নীতিদর্শনের যথাযথ অনুসরণ ও অনুকরণ ২০১৪-এ অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনেও সব অপশক্তি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মহাজোটের সাফল্য হতে পারে অনিবার্য।

সময়ের সদ্ব্যবহারের সুযোগ এখনও অনেক। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ভ্রান্তিহীন সঠিক চিত্র জাতির সামনে উপস্থাপন এবং না-পারা কাজের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যাই হতে পারে সাধারণের পরিপূর্ণ আস্থা ধরে রাখার সর্বোত্তম উপায় । গণপরিপূর্ণ প্রত্যাশা ও অভিব্যক্তির মূল্যায়ন ও তৎপ্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনই রাজনৈতিক সাফল্যের সবচেয়ে বড় শক্তি। এটাই আজ ছয় দফার মূল শিক্ষা । এখানেই ছয় দফার তাৎপর্য।

আরও পড়ুন:

৬ দফা থেকে স্বাধীনতা – সেলিনা হোসেন

ছয় দফা আন্দোলন

Leave a Comment