ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সাঁকো – রামেন্দ্র চৌধুরী : পাক-ভারত যুদ্ধের গ্লানিকর পরাজয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি জনমনে সৃষ্ট তীব্র আইউববিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগাতে সমবেত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দল-মতের নেতৃবৃন্দ। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য আহূত ‘অল পাকিস্তান ন্যাশনাল কনফারেন্স’-এর আহ্বায়কগণ আশা করেছিলেন, ১৯৬৬’র ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিপুলসংখ্যায় অংশগ্রহণ করবেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে সম্মেলনে যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত করলেন।
পূর্ববাংলার স্বার্থ বা কল্যাণসংশ্লিষ্ট বক্তব্যে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ কখনো মনোযোগ দেন না বলেই খোলামেলা বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পাওয়া যাবে না আশঙ্কায় মুজিব লাহোর সম্মেলনে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু মানিক মিয়া বলেছিলেন,
“This will give you a chance to say whatever is on your mind. Not down your thoughts on paper. It does not matter if they don’t want to listen to you. Something good will come out of it anyway.’
মানিক মিয়ার পরামর্শটি মুজিবের পছন্দ হয়েছিল । কিন্তু লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে ৫-৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সম্মেলনের ‘সাবজেক্ট কমিটি’র সভায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয়-দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করলে সমবেত সকলে এতটাই রুষ্ট হয়েছিলেন যে, প্রস্তাবটি সম্মেলনের মূল আলোচ্য-সূচিতেই গ্রহণ করা হলো না। শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিন প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
[ ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সাঁকো – রামেন্দ্র চৌধুরী ]
বঙ্গবন্ধু যখন লাহোরে ৬-দফা উপস্থাপন করেন তখন নিশ্চিত জানতেন এর পরিণতি কী হবে। যে লাহোরে ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল জিন্নাহর দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে, সেই লাহোরেই ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন ছয়-দফা, যা আর কিছুই নয়, দ্বিজাতি তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করার তলোয়ার মাত্র। আইউব-বিরোধী সর্বদলীয় রাজনৈতিক সম্মেলনে উপস্থিত ন্যাপসহ কোনো রাজনৈতিক দলেরই সমর্থন না পাওয়াতেই, ছয় দফা কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনাও করা গেল না।
অতীতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে ক্ষুব্ধ হলেও মুজিব হতাশায় ভেঙে পড়েননি, কখনো বদলে ফেলেননি প্রতিজ্ঞা-প্রস্তুতি । আর এবার তো সবকিছু জেনে-বুঝে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই লাহোর সম্মেলনে গিয়েছিলেন। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে শেষ মুজিব লাহোর বিমানবন্দরের এক অনির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনে ‘ছয় দফা আমাদের বাঁচার দাবি’ এই শিরোনামে প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু প্রায়শ বলতেন, “ছয় দফার সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য। প্রকৃতপক্ষেই ১৯৬৬ সালে ঘোষিত ৬-দফা প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত এক-দফা অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক ভিত্তি রচনা করেছিল।
তেমনই সত্য হচ্ছে, ৬-দফা ঘোষণার অব্যবহিত পরবর্তী সময়টাতে শেখ মুজিবকে প্রচণ্ড প্রতিকূল তিনটি ধারার মোকাবিলা করতে হয়েছে : নিজস্ব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের একাংশ, অপরাপর রাজনৈতিক দল এবং সরকার আপন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞা এবং দলের বৃহদাংশের, বলা চলে, তরুণতর অংশের নিঃশর্ত সহযোগিতা আর সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণঢালা সমর্থনের জোরেই মুজিব সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
‘ছয়-দফা’ শীর্ষক প্রচার-পুস্তিকায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানিরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানিদের নয়, ছোটো বড় নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানির। এমনি উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা… ইনসাফবোধই পাকিস্তানি দেশপ্রেমের বুনিয়াদ, এটা যার মধ্যে আছে, কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক ।… দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দেহের দুই চোখ… দুই হাত… যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে… দুইটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে… তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী।
… পাকিস্তানের মত বিশাল ও অসাধারণ রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে… অন্তরও হইতে হইবে বিশাল অসাধারণ। আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইয়েরা এই মাপকাঠিতে আমার ছয় দফা কর্মসূচির বিচার করবেন দেখিতে পাইবেন… ছয় দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের… নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি।’
দলের প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছয় দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই ঘোষণা করেন : ‘ছয় দফা দাবি রাজনৈতিক দরকষাকষি বা স্ট্যান্টবাজির লক্ষ্যে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই প্রদত্ত হয়েছে।’ উল্লেখ্য যে, দলীয় সভাপতি মওলানা তর্কবাগীশ প্রমুখ কয়েকজন মুজিবের বক্তব্য এবং অবস্থানের প্রতিবাদে বৈঠক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
এ অধিবেশনেই শেখ মুজিবুর রহমান দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তাজউদ্দিন আহমদ সাধারণ সম্পাদক। অতঃপর শেখ মুজিবের প্রতি দলীয় আস্থা এবং জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। যারা অসন্তুষ্ট ছিলেন, তারা একটা ‘বিদ্রোহী’ কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই কার্যকর রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। ততদিনে জন-মনেও ছয়-দফার প্রতি আবেগ এবং আস্থা বেড়ে চলেছে। মার্কিন গবেষক নরেন্স জিরিংয়ের প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ :
The West Pakistani opposition Leaders rejected Mujib’s plan interpreting it was secessionist and hence outside the purview of their deliberation…the Awami league programme pointed up the semi-independent character of East Pakistan and the Six-point demand was judged fundamental to a healthy relationship within and between the provinces. But… Ayub Government joined with the politicians in condemning the proposal’
২০ মার্চ, ১৯৬৬ প্রেসিডেন্ট আইউব ঢাকায় এসেই হুমকি দিলেন, ‘দেশের অখণ্ডতার বিরোধী কোনো প্রচেষ্টা সমর্থন করা হবে না। প্রয়োজনবোধে অস্ত্রের মুখে এর জবাব দেয়া হবে। আর সেদিনই বিকালে পল্টন ময়দানে লাখো লোকের সমাবেশে মুজিব বলেছিলেন, ৬-দফা’ দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনসহ মেনে নিতে হবে। আমরা অনেক রক্তচক্ষু দেখেছি, আর নয়।… দেশের উভয় অংশকে সমান শক্তিশালী করতে হবে।
পাক-ভারত যুদ্ধের সময়… শক্তিশালী কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান নিতান্ত অসহায় এতিমের মত পড়ে ছিল। কেন সঙ্কটের সময় পূর্ব পাকিস্তানকে নিরাপত্তা দিয়ে আশ্বস্ত করা যায়নি? কেন জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে হয়, চীনের জন্যই পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে? কেন আমরা অন্যের অনুগ্রহে বেঁচে থাকবো? অথচ…বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আমরাই আয় করে থাকি’ (১৯/১৪৮)। প্রদেশজুড়ে ৬-দফার প্রচার এবং জনমত গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন জেলায় জেলায় বক্তৃতা করে ফিরছেন আর মোনায়েম খান মামলার পর মামলা দিয়ে তাঁকে বিপর্যস্ত করছেন, তখন আইয়ুবের ‘বিরাগভাজন’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো ঢাকায় এসে আইউবকে খুশি করার বাসনায় বলেছিলেন, ‘৬-দফা বিচ্ছিন্নতাবাদের দলিল।
তিনি ৬-দফার ওপর প্রকাশ্য বিতর্কের চ্যালেঞ্জ দিলেন মুজিবকে। দেশজুড়ে সভা-সমাবেশ আর মামলা সামলানোয় ব্যস্ত মুজিব সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়িত্ব দিলেন ঘনিষ্ঠতম সহযোগী তাজউদ্দিনকে। তাজউদ্দিন বলেছিলেন, ভুট্টো যেদিন যেখানে বলবেন সেখানেই ছয়-দফার ওপর বিতর্ক করতে তিনি প্রস্তুত আছেন। কিন্তু বিতর্কের নির্ধারিত দিনে জরুরি কাজের উছিলায় ভুট্টো ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা-আমলা-রাজনীতিকেরা তো বটেই, পূর্ব বাংলাতেও বিভিন্ন বাম-ডান দলেই ৬-দফার অযৌক্তিক সমালোচনা করেছিল । ‘দুঃখজনক হলেও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে,…ভাসানী এবং তাঁর দল এই ৬-দফার বিরুদ্ধাচরণ করলেন প্রবলভাবে। মওলানা ভাসানী ‘৬৬-র ৭ এপ্রিলের জনসভায় প্রকাশ্যে মন্তব্য করলেন… ৬-দফা দাবির মধ্যে মার্কিনিদের কাজ হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
৬-দফার মধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা নাই, তাই ৬-দফা দাবির প্রতি মওলানা ভাসানী সমর্থন দিতে পারে না।… ভাসানী ন্যাপের সম্পাদক… ‘কমরেড’ তোয়াহা বললেন, ৬-দফা হচ্ছে সিআইএ প্রণীত দলিল’ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহও এই বলে ৬-দফার বিরোধিতা করেছিলেন যে, ‘যেহেতু ৬-দফায় ইসলামী ‘হুকুমত’-এর কথা অনুপস্থিত; সেহেতু এর সমর্থন তো করা যায়ই না বরং এর বিরোধিতাই করতে হবে।
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে, ৬-দফার পক্ষে জনমত গঠন এবং সরকারি দমন-নীতির প্রতিবাদে ৭ জুন প্রদেশব্যাপী আহুত সর্বাত্মক সফল হরতালের দিন ‘ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে আইয়ুব সরকার গুলি চালিয়ে, সরকারি প্রেসনোট মতেই দশজন লোক হত্যা করেছে। সংবাদপত্রগুলোকে প্রেসনোট ছাড়া মন্তব্য ছাপতে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সত্য ঘটনা এবং তৎসম্বন্ধে মন্তব্য বরদাশত করতে চায় না Usurper আইউব খান। প্রদেশের সমস্ত যানবাহন এমন কি রেলগাড়িও বন্ধ ছিল। উল্লেখ্য যে, সাত জুনের হরতাল বিক্ষোভের ১১দিন পরে ৬-দফার বিরোধিতা করে ভাসানী বলেছেন,
‘East Pakistan finds itself in the vortex of imperiailst intrigues in South-East Asia, Many of Bhashani’s followers were so disenchanted with his blatent pro-Ayub stance that they spilit to from a rival NAP under the leadership of Professor Muzaffar Ahmed in East Pakistan and that of Wali Khan in West Pakistan towards the end of 1966
প্রসঙ্গতই উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী পাকিস্তানি মার্কসিস্ট গবেষক তারেক আলীকে (১৯৬৯ সালে) ভাসানী ঢাকায় বলেছিলেন, ‘মাও আমাকে বললেন, এখনও (১৯৬৩) পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্ক নাজুক স্তরে রয়েছে….. আপনি আমাদের বন্ধু এবং বর্তমান মুহূর্তে যদি আপনি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন, তাহলে রাশিয়া, আমেরিকা আর ভারতের হাত শক্তিশালী হবে।
… আমরা আপনাদের এইমর্মে পরামর্শ দেব যে, মন্থরভাবে এবং সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হোন, আপনাদের সরকারের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিবিড় করার জন্য একটা সুযোগ দিন।’ জাগতেই পারে, শুধু এটাই কি মওলানা ভাসানীর আইয়ুবের পক্ষে এবং ৬-দফার বিপক্ষে অবস্থানের একমাত্র কারণ ছিল?
উল্লেখ্য যে, ‘৭ই জুনের হরতালের আগে ঢাকাতে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যাতে ৭ই জুনের হরতালের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয় সেজন্য আইয়ুব সরকার তৎপর হয়ে উঠেছিল।… কেন্দ্রীয় সরকারের তিনজন উচ্চপদস্ত কর্মচারী তখন ঢাকাতে চলে এসেছিলেন। এদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে…কয়েকজন পিকিংপন্থী সদস্য… হরতালের বিরোধিতা…৬-দফা আন্দোলনে বিরোধিতার শর্তে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের সাথে একটা গোপন সমঝোতা’ করে…মোহাম্মদ তোয়াহা, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আব্দুল হক…আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রকাশ্যে বের হয়ে এসেছিলেন।
… ঐ বৈঠকে…৬ দফা কর্মসূচি তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল” (২০/১৯৭-১৯৮)। অবশ্য ‘১৯৬৯ সাল যখন ৬-দফা বাঙালির একমাত্র মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, সে সময় মওলানা ভাসানী ৬-দফার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। কিন্তু যদি তিনি ১৯৬৬-তে ৬-দফার বিরোধিতা না করে শেখ মুজিবের পাশে এসে দাঁড়াতেন, যদি তিনি শেখ মুজিবের গ্রেফতারের পরবর্তীতেই আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে তুলে নিতেন, তবে হয়তো আজ ইতিহাস ভিন্ন সাক্ষ্যই বহন করত।
৬-দফার আলোচনা শেষ করার আগে একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রসঙ্গের উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের ২০০১ সালে পাকিস্তান সফরের সময় উচ্চশিক্ষিত পশতুন যুবক এজাজ এবং পেশোয়ারের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মাস্টার খান গুলের পুত্র, প্রায় ষাট বছর বয়সী মোস্তফা কামালের সাথে আলোচনা হয়েছিল।
শাহরিয়ার এজাজকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শেখ মুজিব সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?? (এজাজের জবাব) পাঞ্জাবিরা তাঁর সম্পর্কে যা-ই বলুক, আমরা পশতুনরা তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের নেতা ওয়ালী খান তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। শাহরিয়ারের প্রশ্ন: ৬-দফাকে বলা হতো বাঙালির মুক্তিসনদ। আপনারা কোন যুক্তিতে ছয় দফা সমর্থন করেছিলেন? মোস্তফা কামাল জবাব দিয়েছিলেন আমরা ৬-দফাকে বিবেচনা করেছি পাঞ্জাবি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বাঙালি, পশতুন, বালুচি ও সিন্ধি জাতির মুক্তিসনদ হিসেবে।
পাকিস্তানের তখন থেকেই ফেডারেল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ছয় দফা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান একটি জাতি-রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানে অনেক জাতিসত্তা রয়েছে, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সব ভিন্ন। এসব জাতিসত্তাকে এক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ধরে রাখতে হলে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।’… পাঞ্জাবিরা বলে শেখ মুজিব বিশ্বাসঘাতক, পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী। পাকিস্তানের অন্য সব জাতিসত্তার কাছে শেখ মুজিব একজন মহান নেতা, পাকিস্তানে ফেডারেল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শাসনব্যস্থার রূপকার, যার জন্য পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তা এখনও সংগ্রাম করছে।”
আরও পড়ুন: