প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিতে ৭ জুন ডা. আবদুল মান্নান চৌধুরী : এ কথা সবারই জানা যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬-দফা কর্মসূচি পেশ করেন । অনেকে ৬-দফাকে মুক্তির সনদ, আমাদের বাঁচার দাবি, ম্যাগনাকার্টা ও স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবেও অভিহিত করেন । কর্মসূচিটি একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা হলেও তাতে পাকিস্তান কনফেডারেশনের স্পষ্ট রূপরেখা ছিল; ছিল পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত, যাকে বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতার সেতু’ বলে ঘনিষ্ঠজনের কাছে উল্লেখ করেছিলেন।
এ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যাদি এখন প্রচুর। ৭ জুন হরতালে খুব বেশি লোক জড়িত ছিলেন না; কিন্তু তারপরও সে দিন সারা পূর্ব পাকিস্তানকে কার্যত অচল করে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের আবহ তৈরি করা হয়েছিল। ঢাকায় আগত হাজার হাজার শ্রমিককে তাদের কর্মস্থল বিশেষত আদমজী এলাকায় ফিরিয়ে দেয়া না হলে কার্যত সে হরতাল সশস্ত্র রূপ নিত। শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সরকারের পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে কাজটি করেন তদানীন্ত ন যুবনেতা সিরাজুল আলম খান। এ ব্যাপারে তার নিজস্ব ভাষ্যসহ অন্যান্য কথা প্রথমে আলোচিত হবে।
[ প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিতে ৭ জুন – ডা. আবদুল মান্নান চৌধুরী ]
এ হরতালটি একান্তই আওয়ামী লীগ আহুত ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র-যুবাদের উদ্যোগেই পালন করার কথা থাকলেও ছাত্র ইউনিয়ন তাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেই হরতালে ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা এ ব্যাপারে তদানীন্তন বিশিষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের লেখা অবলম্বনেও কিছু আলোচনা করব ।
সেদিনের আইয়ুব-মোনায়েমের পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী বিনা উসকানিতে হামলা করেছিল। বাংলাদেশ তথা পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রকাশ্যে রাজপথে ১১ জন আন্দোলনকারী শ্রমিক হত্যা ছিল একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি পড়ে জানা যায়, সেদিন শিল্প এলাকা ছাড়াও কার্জন হলের সামনে আন্দোলনকারী নিহত হন বলে কথা ছড়িয়ে পড়ে; কার্জন হলের সামনে পিকেটিংরত এক ছাত্রনেতা পুলিশের ভয়াবহ হামলার শিকার হলেও বিস্ময়কারভাবে বেঁচে যান। তিনি বেঁচে আছেন এবং ওইদিনের ওপরে বেশকিছু লিখেছেন। তার নাম আবদুল মান্নান চৌধুরী। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় তিনজনের কিছু কথা এ নিবন্ধে তুলে ধরা হল।
সিরাজুল আলম খান ৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে তার এক গ্রন্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করেছেন। বইটির প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স অসত্য অতিরঞ্জিত ও ইতিহাস বিকৃতির উৎস বলে চিহ্নিত করে বাজার থেকে প্রত্যাহার করলেও সেই বইটিই আমার তথ্যসূত্র। হরতালের পূর্বে তিনি হরতালের পটভূমিকা বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ৬-দফার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস টেনে এনেছেন।
৬ দফার পক্ষ-বিপক্ষের কথাই তিনি বলেছেন বেশি। লিখেছেন কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর দোসিনতার কথাও। ছাত্র ইউনিয়ন উভয় গ্রুপ, মওলানা ভাসানী ও মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ৬-দফার বিরোধিতাসহ ইসলামী ছাত্রসংঘের বিরোধিতার কথাও লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’য়ও এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। সিরাজুল আলম খান ওই সময়ে দেশের পত্রিকাগুলোর ভূমিকার কথাও আলোচনা করেছেন।
তিনি ৬-দফা দাবি ঘোষণার ২ মাস পর শেখ মণির মাধ্যমে সে সম্পর্কে জেনেছেন। শেখ মণির সঙ্গে তার দোস্তির সম্পর্ক ছিল এবং ৬-দফা প্রস্তাব’ শিরোনামে এক টুকরো কাগজে হাতে পেয়ে তার মনোভঙ্গিতে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হল যে তিনি শেখ মণিকে কিছু না জানিয়েই বঙ্গবন্ধুর অফিস থেকে চলে আসেন।
কিছু নিন্দুকের মুখে এমন অপপ্রচারও নাকি চালু ছিল যে, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অর্থনীতিবিদ ও মার্কিন সেনাবাহিনীর যৌথ চিন্তার ফসল। আমরা সেসময় তাদের সে অপপ্রচারের জবাব দেয়ার চেষ্টা করতাম (পৃষ্ঠা ৬৪)। অপপ্রচার খণ্ডন ও প্রচারকে জোরদার করতে তিনি তার ‘নিউক্লিয়াস’এর প্রায় চার হাজার সদস্যকে ব্যবহার করেন।
পাশাপাশি মাঝে মাঝেই পোস্টার, দেয়াললিখন, বিবৃতি ও ছাত্রলীগের ছোট-বড় সভা-সম্মেলনের বক্তৃতায় স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ইত্যাদি কথাগুলোর মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও পূর্ব পাকিস্তান পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা চলতে থাকে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা দেয়ার পর তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। তার রচনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্যের গড়মিলও লক্ষ্য করা যায়। তিনি তার রচিত গ্রন্থে এমন কিছু তথ্য যুক্ত করেছেন যে তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল কি না, সে বিষয়েও অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয় ।
হরতাল বাস্তবায়নে সিরাজুল আলম খান সক্রিয় ছিলেন, তবে মাত্র চার দিনের প্রস্তুতিতে এমন একটা মহাযজ্ঞ সাধন বিস্ময়কর বইকি? তিনি জানতেন না যে, শেখ মণির নেতৃত্বে তখন ছাত্ররা ও শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। শেখ মণি যে অনেকের সমর্থন আদায় করেই নেমেছিলে, তা তার জানা ছিল না।
তবে তিনি এটুকু বলেছেন যে, শেখ মণির সহায়তায় তিনি শিঞ্চাল্পলে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন এবং ঢাকার নোয়াখালীর শ্রমিক নেতাদের সহায়তায় হরতাল সফল করেছেন। হরতালের দিন তাকে শ্রমিক ফ্রন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তিনি জানতেন না যে, মনু মিয়া ছাড়া আরও নয়জন শ্রমিক সেদিন নিহত হয়েছিলেন সিরাজুল আলম খানের পর্যবেক্ষণ নিয়েও নানা ধরনের প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
তার একটি পর্যবেক্ষণ এ রকম- ৭ জুনে সংঘটিত এত বড় ঘটনার পরও ৬ দফার প্রতি সংবাদপত্র, সাংবাদিকসমাজ, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মনে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। এবারে আসি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রসঙ্গে মেধাবী এ ছাত্রনেতা তখন রাজনীতির কারণে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ৬-দফা দিবসে তিনি ও তারা ছাত্র ইউনিয়নের পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক পিকেটিংয়ে নামেন পিকেটিংয়ের সময় তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার ও বন্দি হন।
৮ জুন কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হাত নেড়ে সৌজন্য বিনিময় হয় তার। তার বিভিন্ন লেখা থেকে আরও প্রমাণ হয় ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি ৬-দফা ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল। আবদুল মান্নান চৌধুরীও তার এক লেখায় সেদিন বিকেলে কার্জন হলে মতিয়া চৌধুরীর আগমন ও আন্দোলনে সঙ্গতি প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন ৬-দফা ও ৭ জুন ৬-দফা দিবসকেন্দ্রিক তার একাধিক লেখা বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। সেসব লেখায় ৭ জুনের প্রস্তুতি, কর্মপরিকল্পনা ও ঘটনাপঞ্জির বর্ণনা রয়েছে।
৭ জুনের হরতালের সঙ্গে ঢাকা শহরে ছাত্র ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে সিরাজুল আলম খানের কথাও উল্লেখ আছে তিনি ফজলুল হক হলে ২৩২ নম্বর কক্ষে কমপক্ষে ছাত্র যুবাদের দুটো সভার কথা উল্লেখ করেছেন। ওই দুটো সভায় উপস্থিতির বর্ণনাও দিয়েছেন তদুপরি তিনি কীভাবে কৌশলে শেষ মনিকে বন্দিত্ব এড়াতে সহায়তা করেছিলেন, এর রোমাঞ্চকর বর্ণনাও তার লেখায় পাওয়া যায়।
তার লেখায় আরও এসেছে পুলিশের পয়েন্ট ব্লাক গুলি থেকে বাঁচার বর্ণনা, বর্তমান দোয়েলচত্ত্বরে দুটো বাস পুড়িয়ে যানবাহন চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কথা, শহীদ মনু মিয়ার কথা। নূরে আলম সিদ্দীকী মনু মিয়ার রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে ফজলুল হক হলে এলেন। তবে তার বর্ণিত মনু মিয়ার শার্টটি হয়তো মনু মিয়ার ছিল না; ছিল আবুল হোসেনের; যিনি শার্টের বোতাম খুলে আধাসামরিক বাহিনীর কাছে তাকে গুলি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তেজগাঁওয়ের রেললাইনে পিকেট সরাতে নির্দ্বিধায় পাকিস্তানপ্রেমী আধাসামরিক বাহিনী আবুল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন মনু মিয়া, আবুল হোসেনসহ নয়জন শহিদ হন। একদিন পর একাদশ ব্যক্তিটিও মৃত্যুবরণ করেন কোনো ধরনের আগ্রহ দেখা গেল না এমন উক্তিতে তার চিন্তা সম্পর্কে মানুষের।
উৎস : যুগান্তর, ০৭ জুন ২০২০
আরও পড়ুন: