জাতীয়তাবাদ [ Nationalism ] : ব্রিটিশ-ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের যাতাকলে ভারতীয়দের নাভিশ্বাস ওঠে এবং ভিতরে ভিতরে তারা ফুঁসে উঠতে থাকে। একটু একটু করে জাতীয়তাবাদের অনুভূতি মনের মধ্যে পাকাপোক্ত হতে থাকে এবং সে কারণেই ব্রিটিশ শাসন-শোষণের প্রতিবাদ শুরু হয়। জাতি হিসেবে ভারতীয়দের মনে যে হতাশা, অসন্তোষ এবং বিরক্তি ঘটনা পরম্পরায় জমা হয় তার একটি প্রতীকি বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্রিটিশ শাসনের ঠিক একশো বছরের মাথায় ১৮৫৭ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’র মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য যে, সিপাহী বিদ্রোহে দল-মত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
[ জাতীয়তাবাদ ]
ভুলটা ভাঙল কিংবা ভাঙিয়ে দিল সিপাহী বিদ্রোহ এবং সচেতন হয়ে উঠেন ব্রিটিশ শাসনের প্রধান প্রবাহে যাঁরা ছিলেন। কারণ, সিপাহী বিদ্রোহ যে শুধুই সিপাহীদের বিদ্রোহ ছিল না এবং ভারতের হিন্দু মুসলমান মিলিত শক্তি এর মূলে কাজ করেছে, এটা ব্রিটিশদের বোধের গোড়ায় প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয়। সেজন্যই সিপাহী বিদ্রোহের পরে ভারতের হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতিটা ভেঙে দেবার কৌশল অবলম্বনে যত্নবান হয় ব্রিটিশ সরকার। এটা তারা ভালোভাবে পেরেছিল যে, হিন্দু মুসলমান একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে গেলে তাদের পাততাড়ি গোটাতে হবে।
কৌশল তারা ঠিকই উদ্ভাবন করল। ১৯০৯ সালে রাজনৈতিক সংস্কারের নাম করে তারা মুসলমানদের জন্য পৃথক ‘নির্বাচনমণ্ডলী’র ব্যবস্থা করল। ওটাই ছিল শুরু। তারপর ঘটনা পরম্পরায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার আত্মিক সম্পর্কটা ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে থাকে এবং একসময় ভাঙনের ক্ষেত্রটা বেশ ভালোভাবে প্রস্তুত হয়। ফলে ব্রিটিশ-ভারতে একই আত্মীয়বোধে এক হয়ে একদিন স্বাধীনতার জন্য যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল একই পথে, সে পথ বাঁক নিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। পৃথক নির্বাচনমণ্ডলী গঠনের পরে ভারতের মুসলমান নেতারা একদা যাঁদের (হিন্দুদের) সহযাত্রী মনে করতেন তাদের দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজস্ব পথে হাঁটতে শুরু করেন এবং বন্ধু ভাবেন ব্রিটিশদের।
ব্রিটিশরা সুকৌশলে মুসলমানদের মনে সন্দেহের বীজ রোপণ করে দেয় যে, ব্রিটিশরা যদি কখনো ক্ষমতা ছেড়ে যায় তবে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান নেবে এবং তাতে করে মুসলমানরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এসব কথা তখন প্রকাশ্যেও কোনো কোনো ব্রিটিশ মদদপুষ্ট মুসলমান নেতাকে বলতে শোনা গেছে। কারণ, তাদের আবার ব্রিটিশ বন্ধুত্বের সঙ্গে দহরম-মহরমটা বেশি ছিল।
মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনমণ্ডলী গঠন হওয়ার কারণে ভারতের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হয়। মুসলমানদের রাজনীতিতে এটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা গোটা ব্রিটিশ ভারতে একটা স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা অর্জনের স্বপ্ন দেখে। তাদের এই স্বপ্ন জাতীয়তার প্রশ্নে একটি ধর্মীয় মূল্যবোধের জন্ম দেয়। পরে এটিই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’র মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ পায়। দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল সূত্র ছিল— ভারতের বিচ্ছিন্ন অংশে বসবাসকারী মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় বন্ধনের ভিত্তিতেই একটি পৃথক জাতি।
মুসলমান শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে আঞ্চলিক নেতারা বিষয়টিকে এমনভাবে ফেনিয়ে তুলতে থাকে যে, মুসলমানদের মনে পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্নটা সুদৃঢ় হয়ে যায়। তারা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করে বিষয়টি এবং সংগত কারণেই মুসলিম জনমত এর পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠে, ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠন হলেও যুক্তবাংলার হিন্দু-মুসলমানদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। যুক্তবাংলায় হিন্দু-মুসলমানের জীবন ব্যবস্থায় একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে, তারা সব সময়ই সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং ভাষাগত পরিচয়ে বাঙালিয়ানা বজায় রেখে চলেছিল। এ ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক জাতিসত্তা প্রায় উপেক্ষিতই থেকে যায়।
স্বাধীনতার সূচনালগ্নে কিছু নেতা অবশ্য যুক্তবাংলার দাবি জানিয়ে ছিলেন কিন্তু ধোপে টেকেনি। অবশ্য ভুলটা ভাঙতেও সময় লাগেনি। স্বাধীনতার প্রায় অব্যবহিত পরেই দেশবিভাগে দ্বিজাতি তত্ত্বের মতাদর্শ ভুল প্রমাণিত হলো। ইতিহাসে একথা প্রমাণ করে যে, জাতিসত্তা কখনো শুধু ধর্মীয় পরাকাষ্ঠার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে না।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ধর্মীয় ভিত্তিতেই হয়েছিল, একটি ঐকমত্যের জাতি গঠনের প্রত্যাশা সামনে রেখে। তথাপি একই ধর্মীয় মূল্যবোধে অবস্থান থাকা সত্ত্বেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটে এবং প্রমাণ হয়, একটি অচল ও অবাস্তব ভাবাদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দ্বিজাতি তত্ত্ব ভুল ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে সংবাদপত্রে এবং গবেষণাগ্রন্থে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে গুরুত্বারোপ করে সমাজবিজ্ঞানের আদলে পদ্ধতিগত আলোচনা কমই হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থটি এই অভাব পূরণের প্রয়াসমাত্র।
এতে পাকিস্তানের উন্মেষ সমাজবিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলেই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে এবং সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়।
দেশ বিভাগের পর অখণ্ড পাকিস্তান থেকে আবার একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ তরান্বিত করার পিছনে যে সব তাত্ত্বিক বিষয়ের ভূমিকা উজ্জ্বল, তা জাতি এবং জাতীয়তাবাদের নিরিখে এখানে বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: