ছয় দফা শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দেয় –  শওকত আলী

ছয় দফা শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দেয় –  শওকত আলী : মৌলিক গণতন্ত্র পদ্ধতির অধীনে পাকিস্তানে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আল জিন্নাহর বোন সম্মিলিত বিরোধী দল বা Combined Opposition Parties (COP) সমর্থিত প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে আইউব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

ছয় দফা শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দেয় -  শওকত আলী [ ৮০ ]

 

১৯৬০ সালের প্রথমদিকে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা তথাকথিত গণভোট (হ্যাঁ-না-ভোট) অনুষ্ঠান করে আইউব খান তাঁর আগের মেয়াদের পাঁচ বছরের শাসনকে জায়েজ করেছিলেন। ইতিপূর্বে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন জারি করে তথাকথিত বিপ্লব ঘটিয়ে তিনি ১৯৬০ সালের পূর্বের সময়কালের শাসনকে বৈধতা প্রদান করেছিলেন।

[ ছয় দফা শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দেয় –  শওকত আলী]

১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচার অভিযানের সময় পাকিস্তানের অংশে অনুষ্ঠিত জনসভা এবং পথসভাসমূহে মিস জিন্নাহ আইউব খানের চাইতে অধিক সংখ্যক জনতাকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতি ছিল বেশিরভাগ জনগণের আস্থা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের কোনো ভূমিকাই ছিল না। কেননা ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ৪০,০০০ করে মোট ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত নির্বাচনকমণ্ডলী দ্বারা।

এক ব্যক্তি এক ভোট’- এ ভিত্তিতে বা প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা সত্ত্বেও আইউব খান নির্বাচনের বিরাট ব্যবধানে পরাজিত হতেন। এমনকি গণতন্ত্র পদ্ধতির অধীনে নির্বাচনেও মিস ফাতেমা জিন্নাহর চেয়ে তার প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান খুব বেশি ছিল না এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভোটের ব্যবধান খুবই কম ছিল।

১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে দৃঢ় ভিত্তির উপর আইউব খান পুনরায় শাসন ক্ষমতায় আসীন হলেন। সে সময় ৭থেকেই সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিষয়ে আমরা সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালিরা গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা শুরু করলাম। আমি তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অর্ডিন্যান্স ডিপোতে কর্মরত ছিলাম। আমার ধারণা, অনেক বাঙালি অফিসার ঠিক আমারই মত চিন্তা-ভাবনা করত।

সাধারণত বাঙালিদের মধ্যে তথা সেনাবাহিনীতে কর্মরত নিম্নপদের বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ১৯৬৫ সালের প্রায় পুরো বছরটাই আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব চাপা ছিল। তার প্রথম কারণ হলো, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সীমান্তে কচ্ছের রান এলাকায় ১৯৬৫ সালের প্রথমদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ এবং দ্বিতীয়ত ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ।

স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিরূপণের লক্ষ্যে এই পুরো সময়টাতেই আমি নিজস্ব ভাবনায় নিবিষ্ট ছিলাম। পরিকল্পনার রূপরেখা ছিল, কোনো এক নির্দিষ্ট রাতের নির্দিষ্ট সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল সেনানিবাসে একই সময়ে আমরা বাঙালিরা আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা।

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো একদিন সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত ৬-দফা কর্মসূচি সম্বন্ধে প্রচারিত সংবাদ পড়লাম, যা তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলসমূহের নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে পেশ করেছিলেন। সম্ভবত সংবাদপত্রটি ছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘দি মর্নিং নিউজ’, যাতে শুধুমাত্র ১ থেকে ৬ পর্যন্ত দফাগুলো বিবৃত ছিল। কোন মন্তব্য বা সবিশেষ বর্ণনা ছিল না। ধারাগুলো নিম্নরূপ

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে, আইন পরিষদ হবে সার্বভৌম এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে আইন পরিষদ গঠিত হবে।

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধুমাত্র তিনটি বিষয়, যথা-প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রাব্যবস্থা, অন্য সকল ক্ষমতা ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত অঙ্গরাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. দেশের দুটি অঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধ হস্তান্তরযোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। অথবা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকতে হবে এবং পৃথক রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি চালু করতে হবে ।

৪. সব ধরনের কর ও শুল্ক ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা অঙ্গরাজ্য সরকারগুলোর হাতে থাকবে। তবে রাজ্যের আদায়কৃত অর্থে কেন্দ্রের নির্দিষ্ট হিস্যা থাকবে যা দিয়ে ফেডারেল তহবিল গঠিত হবে এবং ফেডারেল সরকারের খরচ নির্বাহ হবে।

৫. বৈদেশিক বাণিজ্যচুক্তি, বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধিদল প্রেরণসহ ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যগুলোকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে হবে। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুটি পৃথক হিসাব থাকবে এবং স্ব স্ব অঙ্গরাজ্য তা নিয়ন্ত্রণ করবে। অঙ্গরাজ্যগুলো সমান হারে অথবা কোনো সম্মত হারে কেন্দ্রীয় সরকারে জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাবে। দেশীয় পণ্য এক অংশ থেকে অন্য অংশে অবাধে প্রবেশাধিকার লাভ করবে।

৬. আঞ্চলিক সংহতি রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দিতে হবে।

৬-দফা কর্মসূচির অন্তর্নিহিত ভাবধারা আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে আকৃষ্ট করল এবং আমার ধারণা হলো যে, বাঙালিরা এই কর্মসূচি আন্তরিকভাবে সমর্থন করবে, যা তারা আশাতীতভাবে করেছিল। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মুজিব ভাইয়ের অন্তরে এক দফা অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্রিয়াশীল ছিল এবং ৬-দফা কর্মসূচি উপযুক্ত পটভূমি হিসেবে এক দফায় উন্নীত হতে সাহায্য করবে।

অতি অল্প শব্দ ব্যবহার করে প্রস্তুতকৃত কর্মসূচিটি স্বাধীনতার সমর্থনে সরাসরি তেমন কিছুই ব্যক্ত করেনি। কিন্তু কারো মনে সন্দেহ রইল না যে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য সামনে রেখেই ৬-দফা কর্মসূচি দিয়েছেন। শুধু পাকিস্তানের তিনি একটা সুযোগ দিয়েছিলেন, ৬-দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা আপাতত অক্ষুণ্ণ রাখতে, নতুবা এক-দফার দিকে দ্রুত ধাবমান হতে।

আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে পাকিস্তানিরা কিছুতেই ৬-দফা কর্মসূচি মেনে নিতে সম্মত হবে না । যা পরবর্তী ঘটনাবলী দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল। সুতরাং এক-দফা বাস্তবায়নের আরও সংঘবদ্ধ প্রস্তুতির প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছিল। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আমার আস্থা আরো গভীর হয়েছিল।

৬-দফা কর্মসূচি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরই আইউব খানের সহযোগিতায় বিভিন্ন সংবাদপত্র ৬-দফা কর্মসূচির বিরূপ সমালোচনামূলক বিবৃতি প্রদান করতে শুরু করল। যার ফলে কর্মসূচিটি অধিকতর জনপ্রিয় হতে থাকল। ইত্যবসরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ কর্তৃক ৬-দফা কর্মসূচি যথারীতি গৃহীত হয় এবং ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যাসম্বলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।

বঙ্গবন্ধু সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ঝটিকা সফরে মাধ্যমে জনসভা করতে লাগলেন। জনসভাগুলোতে নজিরবিহীন জসসমাগম হয় এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ৬-দফা কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রদর্শন করে। সংবাদপত্র পড়ে এবং লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমি বুঝতে পারছিলাম কী ঘটতে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু দ্রুত বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ প্রদর্শনের জন্য বাঙালি প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ আইউব খানও জানতেন কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু দেওয়ালের লিখন না পড়ে এবং রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে তিনি সামরিক কায়দায় প্রতিঘাত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি গৃহযুদ্ধের কথা বলে অস্ত্রের ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে ভয় দেখালেন।

৬-দফার মতো পুরোদস্তুর একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে আইউব খানের অসাড় ও অরাজনৈতিক বিস্ফোরণ বাঙালিরা মেনে নেয়নি। দেশপ্রেমিক বাঙালিরা যুক্তি দেখাল যে ৬-দফা কর্মসূচিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির অতিরিক্ত কিছুই নেই ।

৬ দফা কর্মসূচি মেনে নিলে পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেত এবং একই সঙ্গে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থসমূহ যা দীর্ঘকাল যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রশাসনিক দমননীতির কারণে উপেক্ষিত হয়েছিল, তার রক্ষা করা যেত। যে আকারের স্বায়ত্তশাসন পেলে ১৯৫৬ সালে বাঙালি সন্তুষ্ট হতো, ১৯৬৬ সালে তা চায়ের কাপের সমতুল্য মনে হয়েছিল। কারণ, ৬-দফা কর্মসূচিতে স্বাধীনতার কথা বলা না হলেও, চরম প্রকৃতির আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের উল্লেখ ছিল।

এ কথা মানতেই হবে যে, যদি রাজনৈতিক সমস্যাবলী যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা না হয় এবং যথাসময়ে সমাধান করা না যায়, তাহলে সেগুলো আরো বড় আকার ধারণ করে বিবদমান শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে দারুণ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে এবং এতদূর গড়ায় যে পরে যার আর কোনো মীমাংসার সম্ভাবনা থাকে না।

১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেনে নেয়নি। আইউব খান তো স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসীই ছিলেন না এবং এটাকে অর্থহীন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয় হিসেবে মন্তব্য করতেন। সুতরাং ১৯৬৬ সালে কঠিন শর্তসম্বলিত স্বায়ত্তশাসনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলো আইউব খানকে।

৬-দফা কর্মসূচির প্রতি বাঙালিদের অবিচল বিশ্বস্ততা লক্ষ্য করে, আইউব খান তার বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠলেন। সে কারণে গৃহযুদ্ধের অজুহাত খাড়া করে অস্ত্রের ভাষার ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রাখলেন। কিন্তু বাঙালি ভ্রূকুটি তথা হম্বি-তম্বিতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়নি।

আইউব খান ও তদীয় গভর্নর মোনায়েম খানের ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও বাঙালিরা ৬-দফা কর্মসূচির প্রতি দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখল। এই দুই ভদ্রমহোদয় একজন সম্রাট এবং আরেকজন জায়গীরদার হিসেবে একটি অসম পার্টনারশিপ গঠন করেছিলেন। আইউব খান মুকুট পরে সম্রাটের ভূমিকায় ছিলেন এবং মোনায়েম খান প্রভুর পাদুকাদ্বয় মার্জনে ব্রত থেকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে কোনো কাজ করতে সদা প্রস্তুত থাকতেন।

১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় বারোটিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। উল্লিখিত মামলাসমূহের গ্রেফতার পরোয়ানা কার্যকর করতে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে মোনায়েম খানের নির্দেশে প্রাদেশিক সরকার যে নিপীড়নমূলক এবং নীতিবিবর্জিত পন্থা অবলম্বন করেছিল, তাতে সকল মহল বিক্ষুব্ধ হয়েছিল।

খুলনায় এক জনসভায় বক্তব্য প্রদানের পর ঢাকায় ফেরার পথে যশোরে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের ভিত্তি ছিল ঢাকার একটি জনসভায় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে ঢাকা থেকে জারি করা একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা। খুলনা থেকে ঢাকা ফেরার পথে যশোরে তাঁর গতিরোধ করে গ্রেফতার করার কোন প্রয়োজন ছিল না। ঢাকায় ফিরে আসার পর খুব সহজেই এ ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেফতার করা যেত।

এই গর্হিত কাজের উদ্দেশ্যে ছিল তাঁকে হয়রানি ও উৎপীড়ন করা। কিন্তু এর ফলে তিনি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন । যশোর সদরের এসডিও মহোদয়ের কোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন লাভ করে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা সদরের এসডিও মহোদয়ের নিকট জামিনের প্রার্থনা জানালে তা না-মঞ্জুর হয়। কিন্তু একই দিনে ঢাকার মাননীয় দায়রা জজ তাঁর জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন। সিলেট থেকে জারি করা এক গ্রেফতারি পরোয়ানার ভিত্তিতে ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ঢাকার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে সিলেট নিয়ে যাওয়া হয়।

সিলেট সদরের এসডিও মহোদয় তার জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন, কিন্তু সিলেটের বিজ্ঞ দায়রা জজ তাঁর জামিনের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। ময়মনসিংহ থেকে জারি করা অপর একটি ওয়ারেন্টের বলে তাঁকে সিলেট জেল গেটেই পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং সেখান থেকে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া হয়। ময়মনসিংহ সদরের এসডিও মহোদয় তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করলে, বিজ্ঞ দায়রা জজ তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন।

১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে শেখ মুজিবকে পর্যায়ক্রমিক গ্রেফতারের মাধ্যমে আইউব-মোনায়েম জুটি যে নাটকের অবতারণা করেছিল এবং যার উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে কঠোর শাস্তি দেওয়া, তা শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে ১৯৬৬ সালের ৯ মে তারিখে ডিপিআর বা ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস-এর অধীনে তাঁকে শেষবারের মতো গ্রেফতার করা পর্যন্ত প্রতিদিন সংবাদপত্রসমূহ বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার ও জামিনে মুক্তি নাটকের সংবাদ পরিবেশন করে তাঁকে করেছিল।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment