ছয় দফা বাঙালির স্বাধীনতার সূচনা – ইমরান ইমন : বাঙালি বীরের জাতি অধিকার আদায়ে এ জাতি সব সময়ই ছিল আপসহীন। যুগ যুগ ধরে শাসকগোষ্ঠীর যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার থেকেছে। ক্ষমতাবলে অসীম হলেও তারা ব্রিটিশ শাসকদের সামনেও কখনো মাথা নত করেনি।
পাকিস্তানি শাসক-শোসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতনে জর্জরিত বাঙালি দৃঢ়কণ্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছে। ১৯৫২ সালের হার না মানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার একের পর এক ন্যায্য প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে। এ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলাকে চিরতরে স্বাধীন করার বীজ বপন করা হয় ১৯৬৬ সালের ছয় দফার দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে।
[ ছয় দফা বাঙালির স্বাধীনতার সূচনা – ইমরান ইমন ]
আর এ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবি বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিস্তম্ভম্বরূপ। ছয় দফাকে বাঙালির ‘ম্যাগনাকাটা’ বা ‘মুক্তির সনদ’ বলে অভিহিত করা হয়। দীর্ঘকাল ধরে অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতি ‘ছয় দফা দাবি’ উত্থাপনের মধ্য দিয়ে পেয়েছিল নতুন এক ভোরের সূচনা।
ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা । ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬-দফা দাবি পেশ করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের লাহোরে পৌছান এবং তার পরদিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ৬-দফা দাবি পেশ করেন। এ দাবি উত্থাপনের জন্য ৬ ফেব্রুয়ারির পাকিস্তানি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে অভিহিত করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে মিল রেখে ২৩ মার্চ। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়।
৬-দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে এ আন্দোলন এতই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে, এজন্য একে বাঙালির ‘ম্যাগনাকাটা’ বা ‘মুক্তির সনদও’ বলা হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬-দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহিদ হন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুই অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং পাকিস্তানের মোট রফতানি আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ রফতানি হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সমতা ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানিরা সব দিক দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানিদের শোষণ করত।
বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এর ফলে অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা বৈষম্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে এবং ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রথম দফা—
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি : দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারি ধরনের। আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
দ্বিতীয় দফা—
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যথা- দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি । অবশিষ্ট সব বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ ।
তৃতীয় দফা –
মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা : মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দুটির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে- (ক) সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে; অথবা (খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবলমাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে পূর্ব পাকিস্ত ান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
চতুর্থ দফা-
রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলোর কর শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের থাকবে না। প্রয়োজনীয় নির্বাহের অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সবরকমের করের শতকরা নিয়ে সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
পঞ্চম দফা—
বৈদেশিক বিষয়ক ক্ষমতা: (ক) ফেডারেশনভুক্ত রাজ্যের বহিঃবাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব বহিঃবাণিজ্যের অর্জিত অঙ্গরাজ্যগুলোর এখতিয়ারাধীন থাকবে। (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা হারে সর্বসম্মত মিটাবে। অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের শুল্ক বা কর জাতীয় কোনরকম বাধা-নিষেধ থাকবে (ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে বিদেশে নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
ষষ্ঠ আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক আঞ্চলিক সেনাবাহিনী ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
১৯৬৬ প্রণীত দফার দাবিসমূহ সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা বঙ্গবন্ধুর দফা কর্মসূচি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমস্যাবলির নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের প্রণীত একটি বাস্তবায়নযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচী। এতে উভয় প্রদেশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা এ ছয় দফা কর্মসূচী দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পাওয়া
ছয় দফা আন্দোলনের মধ্যেই আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রোপিত ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে এই ছয় দফা আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ এজন্য ছয় দফাকে ‘ম্যাগনাকার্টা’ অভিহিত হয়।
আরও পড়ুন: