বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি শুধুমাত্র একটি দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাহিনী নয়, বরং জনগণের সংগ্রাম, ত্যাগ এবং স্বাধীনতার প্রতি তাদের অদম্য আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ও তার প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস

ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫২ সালের গণঅভ্যুত্থান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে বাঙালি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতি তার মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও কয়েকজন ভাষা সৈনিক নিহত হন। এই ঘটনায় দেশব্যাপী ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জোয়ার উঠে। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাঙালির দাবির মুখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এই ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করে।

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস

 

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই অভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবির প্রেক্ষিতে। ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি, যা বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল।

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্ত করা হয় এবং তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বাভাস হিসেবে কাজ করে।

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণঅভ্যুত্থান হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করে।

এর প্রতিক্রিয়ায় ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ ৯ মাস ধরে চলে এবং ৩০ লক্ষ বাঙালি শহীদ হন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়।

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস

 

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারো গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় ১৯৯০ সালে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সামরিক শাসনের অধীনে পড়ে। এর পর ১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং দীর্ঘ ৮ বছর দেশ শাসন করেন। এরশাদের শাসনকাল ছিল স্বৈরাচারী এবং গণতন্ত্রহীন।

এর বিরুদ্ধে জনগণ ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে এবং ১৯৯০ সালের দিকে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া অবিরাম হরতাল, অবরোধ, ও বিক্ষোভের মুখে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা জাতির স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানই দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং বাঙালি জাতির মননে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তুলেছে। এই ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের জনগণ বারবার শিখেছে যে, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়গুলো আজও বাংলাদেশের জনগণের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে, এবং ভবিষ্যতেও তা জাতির প্রগতির পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে থাকবে।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment