আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর – আবুল মনসুর আহমদ

আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য গ্রন্থ। স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা এই বইটিতে লেখক ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে পুরো পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তী সময় পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত সরল ও অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। লেখক নিজে ছিলেন এই সময়ের অনেক ঘটনার সাক্ষী, কিছু ঘটনায় তাঁর ছিল সরাসরি অংশগ্রহণ। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর সে অভিজ্ঞতারই বস্ত্তনিষ্ঠ বয়ান পাওয়া যায় বইটিতে। কৌতূহলী পাঠক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের কাছে বহুদিন ধরেই এ বই একটি মূল্যবান ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-আকর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

 

আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর - আবুল মনসুর আহমদ

লেখক সম্পর্কে দুটি কথা

মরহুম আবুল মনসুর আহমদ-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের সপ্তম সংস্করণ প্রকাশনা উপলক্ষ্যে কয়েকটি কথা বলতে হয়।

আবুল মনসুর আহমদ-এর দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। সাহিত্যের সেই দিকটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন যেটা ছিল সবচেয়ে কঠিন–ব্যঙ্গ-সাহিত্য। সাহিত্যের অন্যান্য আঙ্গিনায়ও স্বচ্ছন্দ্যে পদচারণা করেছেন তিনি। যে অঙ্গনেই তিনি কাজ করেছেন সেখানেই শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ব্যঙ্গ-সাহিত্য বলতে গেলে উভয় বাংলায় তিনিই ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর প্রতিটি স্যাটায়ারই কালোত্তীর্ণ।

সমাজপতি, ধর্মগুরু, রাষ্ট্রপতি, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী যেখানেই তিনি কোন দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই করেছেন কশাঘাত। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের রসাঘাত কশাঘাতে রূপ নিয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। এ আঘাত ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ আচার অনুষ্ঠানকেই আক্রমণ করেনি–যারা এসব প্রসঙ্গ নিয়ে মিথ্যার জাল বুনন করতেন তাদেরকেও তিনি নাস্তানাবুদ করেছেন। এসব রচনার পাঠকদের মনে হবে চরিত্রগুলো সবই চেনা। এদের কার্যকলাপও জানা।

‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ তার দীর্ঘজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। যারা এদেশে রাজনীতি করতে আগ্রহী তাদের সকলের জন্যে এই বইটি অবশ্য পাঠ্য। এতে রয়েছে এদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস। দেশীয় রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে হলে এর সঙ্গে আরও পড়তে হবে তার লেখা ‘বাংলাদেশের কালচার’, ‘শেরে বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু’, ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি বইগুলো।

‘রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ একজাতীয় স্মৃতিকথা আত্মজীবনী। রাজনীতির স্মৃতি এতে স্থান পেয়েছে। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ওকালতি ইত্যাদি কর্মজীবনের বহুমুখী স্মৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘আত্মকথা। এসবের একত্রে মিশ্রণ ঘটেছে বিশালাকারের ইংরাজি গ্রন্থ ‘End of a Betrayal’। ইংরেজি উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর দুটি অমর কীর্তি ‘জীবন ক্ষুধা’ ও ‘আবেহায়াত’।

রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য দফতরসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরসমূহের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সাহিত্য সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে, রসসাহিত্যে আজ পর্যন্ত উভয় বাংলার কেউ তার প্রতিভার সমকক্ষ এমনকি কাছাকাছিও আসতে পারেননি।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কলকাতার খাদেম, সুলতান, দি মুসলমান, মোহাম্মদী প্রভৃতি সাপ্তাহিক ও দৈনিক কৃষক, নবযুগ ও ইত্তেহাদের সম্পাদনাকালে তিনি অনেক ক্ষণজন্মা সাংবাদিক ও সম্পাদকের গুরু, প্রশিক্ষণদাতা ছিলেন। কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, রশীদ করিম, আহসান হাবিব, ফররুখ আহমদ, খোন্দকার আবদুল হামিদ, রোকনুজ্জামান খান, কে. জি. মুস্তাফা প্রমুখ ব্যক্তিগণ কোন না কোন সময়ে তার সহকর্মী ছিলেন।

এসব অভিজ্ঞতার মধ্যে খ্যাতি, যশ, সম্মান যেমন ছিল তেমনি ছিল সামরিক শাসনকালের কারাযন্ত্রণা। সে কারণেই তিনি আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর লিখেছেন। ‘শোনা’ বা ‘পড়া নয়’।

বিশাল ও বিস্তৃত কর্মজীবনে তিনি মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ নওশের আলী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মিঞা ইফতেখারউদ্দিন, মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী, জি. এম. সৈয়দ, মিঞা মমতাজ দৌলতানা, আবুল হাশিম প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন এবং ব্রিটিশ ভারত ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল ব্যক্তিগত পরিচয় ও গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল ‘তুমি তুমি’ পর্যায়ের। জাতীয় কবি নজরুলের সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সগৌরবে লেখককে লীডার বলতেন এবং নিজেকে তাঁর শিষ্য বলতেন সেই কলকাতার কলেজ জীবন থেকেই।

তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।

এদেশে রাজনীতি করেছেন অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য চর্চা করেছেন অনেক মহীরূহ। সাংবাদিকতা করেছেন অনেক তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। কিন্তু এসবের সমারোহ ঘটাতে পেরেছেন কয়জন?

সে হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ এক ও অদ্বিতীয়।

— মহবুব আনাম

 

PoliticsGurukul.com, Logo - 252x68 px White

 

আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর সূচি

০১. রাজনীতির ক খ

০২. খিলাফত ও অসহযোগ

০৩. বেংগল প্যাক্ট

০৪. প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা

০৫. ময়মনসিংহে সংগঠন

০৬. প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল

০৭. প্রজা আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি

০৮. আইন পরিষদে প্রজা পার্টি

০৯. নির্বাচন-যুদ্ধ

১০. হক মন্ত্রিসভা গঠন

১১. কালতামামি

১২. কৃষক-প্রজা পার্টির ভূমিকা

১৩. পাকিস্তান আন্দোলন

১৪. পাকিস্তান হাসিল

১৫. কলিকাতায় শেষ দিনগুলি

১৬. কালতামামি

১৭. আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা

১৮. যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা

১৯. পাপ ও শাস্তি

২০. ঐতিহাসিক মারি-প্যাকট

২১. আত্মঘাতী ওয়াদা খেলাফ

২২. ওয়ারতি প্রাপ্তি

২৩. ওযারতি শুরু

২৪. ভারত সফর

২৫. কত অজানারে

২৬. ওযারতির ঠেলা

২৭. ওযারতি লস্ট

২৮. ঘনঘটা

২৯. ঝড়ে তছনছ

৩০. কালতামামি

৩১. পুনশ্চ

৩২. ০১ প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন

৩২. ০২ নয়া যমানার পদধ্বনি

৩২. ০৩ পৃথক পথে যাত্রা শুরু

৩২. ০৪ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক

৩২. ০৫ মুক্তিযুদ্ধ-জন-যুদ্ধ

৩২. ০৬ মুজিবহীন বাংলাদেশ

৩২. ০৭ নৌকার হাইলে মুজিব

৩২. ০৮ সংবিধান রচনা

৩২. ০৯ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন

৩২. ১০ কালতামামি

 

আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর - আবুল মনসুর আহমদ

আহমদ ছফার লেখায় আব্দুর রাজ্জাকের বয়ানে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে, ‘সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে তার লগে দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন তো আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায় কথায় আমি জিগাইলাম, আপনার হাতে তো অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনরে কী করবেন।

অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে। জওহরলাল নেহেরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশান পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী নির্বাচনে অপজিশান পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম ৫টার বেশি আসন পাইব না। আমি একটু আহত অইলাম, কইলাম, আপনি অপজিশনরে ১০০ সিট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।’

‘ঢাকা সেন্ট্রাল জেল নানা রঙের দিনগুলি’ বইয়ে ডা. এম এ করিম ঠিক কাছাকাছি একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন। সেখানে উল্লিখিত হয়েছে, ‘বহুদিন পরে শেখ মুজিবের সাথে দেখা। তিনি তখন জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী কত কী। কিন্তু শেখ মুজিব তেমনি আছেন। বললেন, কি রে তুই যে একবারও দেখা করতে এলি না, ব্যাপার কী বলত? বললাম, আমার প্রয়োজন থাকলে তো আসব। জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি। বললাম ভালো। তারও কুশল জিজ্ঞেস করলাম। অনেক কিছুই আলাপ হলো।

শেষে আমি বললাম, সামনে তো ইলেকশন। অন্তত ভাল দেখে ৫০ জন বিরোধী দলীয় সদস্যদের সংসদে আসতে দিও, ভাল হবে। শেখ তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন কীসের ভাল হবে বলতো? তুই কি আমার থেকে বাংলাদেশ বেশি চিনিস? আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছি, আমি সবগুলোকে চিনি। ওরা আমার কাছ থেকে গোপনে এসে টাকা নিয়ে যায়। টাকাও দেবো, সিটও দেবো তা কোনদিন হয়? হয় সিট, নয় টাকা। আমি বললাম তুমি যেটা ভাল বুঝবে করবে। আমার বলার ছিল বললাম।

…আজকের রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন, তা শেখ মুজিবের সময় থেকে নতুন মাত্রা পেয়েছে। মুজিব জানতেন কিন্তু কোথায় যেন অসহায় ছিল অথবা পরোক্ষ প্রশ্রয় ছিল। অথচ আক্ষেপ করে বলতেন, সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’

‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে আবুল মনসুর আহমদও ঠিক এরকম একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি যেহেতু রাজনীতিবিদ, সেই লেখায় তার ছাপও মেলে। তবে তার ভবিষ্যদ্বাণী পরিষ্কার ও স্পষ্ট এবং সংসদীয় রাজনীতিতে বিষয়টা কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেই প্রসঙ্গেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং সেটা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, সময়ের পরিক্রমায় সেটা রূঢ় এক সত্য রূপেই উপস্থিত হয়েছে।

আবুল মনসুর আহমদ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি কিন্তু ঘরে বসিয়াই স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিলাম, আওয়ামী লীগের ডর ও বিরোধী দলের আশা দুইটাই অমূলক। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ মেজরিটিই পাইবে। আওয়ামী বন্ধুদের কাছে মুখে মুখে যেমন এ কথা বলিতেছিলাম, কাগজেও তেমন লিখিতেছিলাম: ‘আওয়ামী লীগ শুধু আসন্ন নির্বাচনেই নয়’ আগামী ২৫ বছরের নির্বাচনে জিতিবে এবং দেশ শাসন করিবে।

আমি এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ শাসনকে ভারতের কংগ্রেসে ২৫ বছরের আমলের সাথে তুলনা করিয়াছিলাম। লিখিয়াছিলাম, নেহেরু নেতৃত্বের কংগ্রেসের মতো মুজিব নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথে দৃঢ় থাকিলেই এটা অতি সহজ হইবে। এই বিশ্বাসে আমি আওয়ামী নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, বিরোধী পক্ষের অন্তত জন পঞ্চাশেক নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করিতে দেওয়া উচিত। তাতে পার্লামেন্টে একটি সুবিবেচক গণতন্ত্রমনা গঠনমুখী অপজিশন দল গড়িয়া উঠিবে।’

আব্দুর রাজ্জাক, ডা. এম এ করিম ও আবুল মনসুর আহমদ এই ৩ জনের ভাবনা কতটা সমান্তরাল তা দেখিয়া আমরা বিস্মিত না হইয়া পারি না। আব্দুর রাজ্জাক ১০০টা আসন বিরোধী দলকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছেন। ডা. এম এ করিম ও আবুল মনসুর আহমদ বলছেন ৫০টা করে ছেড়ে দেওয়ার কথা। তারা যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে এবং খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে ন্যূনতম ৫০ আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেদিন যদি বাস্তবিকই তাদের কথা শোনা হতো, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস অন্যরকম হতো। আবুল মনসুর আহমদকে পাঠ করা এ কারণেই প্রয়োজন, কারণ তাকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পাই, নানাভাবে নিজেদের ঋদ্ধ করতে সামর্থ্যবান হয়ে উঠি।

বিংশ শতাব্দী এই পৃথিবী নামক গ্রহের কাছে নানা কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, দু’ দুটো বিশ্বযুদ্ধ এই সময়কালেই সংঘটিত হয়েছে। পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যে যেমন নানা রকমের তত্ত্ব-পাল্টা তত্ত্ব, মত-দ্বিমত উদ্ভাবিত হয়েছে, তেমনি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সাধিত হয়েছে অভূতপূর্ব সব আবিষ্কার। এ তো গেল গোটা বিশ্বের চিত্র। এর বাইরে এই উপমহাদেশে তথা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এই শতাব্দী স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। যদিও সেই স্বাধীনতা ভারতকে বিভক্ত করেছে, বাঙালিকে দেশভাগের মতো ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাবিধূর বিভক্তি ও মর্মান্তিক এক গণহত্যার সাক্ষী হতে হয়েছে। বাঙালিকে প্রায় পুরো শতাব্দী জুড়ে জ্বলতে-পুড়তে হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে।

বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডের মানুষকে দুই দুইবার স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রথমবারের স্বাধীনতা ফিকে হওয়ায় ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি ও ৩ লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতাকে খুঁজে পেতে হয়েছে। সময়ের এই নানামুখী যাত্রা-অভিজ্ঞতার বহু বর্ণিল তরঙ্গাভিঘাতকে জানতে বুঝতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়, তালাশ করতে হয় অজস্র সব উপাদান-উপকরণ-বইপত্র। তবুও খেই হারাতে হয় পদে পদে, হাতরে বেড়াতে হয় সময়ের খণ্ড-বিখণ্ডকে উপলক্ষ করে লেখা ও গবেষণার অলি-গলিতে।

এ ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদ স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী এক প্রতিভা। তিনি বিংশ শতকের ৫০ বছরকে হাজির করেছেন রাজনৈতিক সাহিত্য ও দার্শনিকতার মিশেলে বুদ্ধিবৃত্তির নিজস্ব বয়ান ও বিন্যাসে। বাঙালির জীবনাচার, যাপিত জীবনের বোধ, সামাজিক গড়ন, ধর্মপ্রীতি, রাজনীতির অভিমুখ-বাঁকবদল এবং ঐতিহাসিক ঘটনার পূর্বাপর, দূরদর্শিতা ও ভুলের পুনরাবৃত্তি-সংশোধনের সুযোগসমূহকে বুঝতে হলে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ শুধু পাঠ নয়, এর থেকে ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে জানতে পারি, পথ ও পন্থা খুঁজে নেওয়ার ধারাপাত শিখতে পারি।

আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘আমি দেখিয়া খুবই আতঙ্কিত ও চিন্তাযুক্ত হইলাম যে নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব অপজিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন, সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না। তারা যেন নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন। নির্বাচনের ফলে অপজিশন একরূপ শূন্যের কোঠায় পৌঁছিয়াছিল। কয়েকটি দলের এবং নির্দলীয় মেম্বর মিলিয়া শেষ পর্যন্ত তারা হইলেন মাত্র ৮ জন। অপজিশন ছাড়া পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ হয় না। কাজেই এই ছিন্নভিন্ন অপজিশনকে লালন করিয়া আমাদের আইনসভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টের রূপ ও প্রাণ দিবার চেষ্টা শাসকদলেরই অবশ্য কর্তব্য ছিল।

শাসকদল সে কর্তব্য পালন তো করিলেনই না, ভিন্ন ভিন্ন দলের মেম্বররা নিজেরাই যখন একত্রিত হইয়া জনাব আতাউর রহমানকে লিডার নির্বাচন করিলেন, তখনও সরকারি দল তাকে লিডার অব দি অপজিশন স্বীকার করিলেন না। নির্বাচনের পরে নয় মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হইয়াছে। এর মধ্যে পার্লামেন্টের দুই দুইটি অধিবেশনও হইয়া গিয়াছে। তবু আমাদের পার্লামেন্টে কোনো লিডার অব দি অপজিশন নাই। তার মানে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে আমাদের আইন পরিষদ আজও পার্লামেন্টে হয় নাই।

যা হইয়াছে সেটা আসলে একদলীয় আইনসভা। এটা নিশ্চিতরূপে অশুভ। প্রশ্ন জাগে: আমরা কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হইতেছি? কিন্তু তা বিশ্বাস করিতে মন চায় না। কারণ এটা শুধু আওয়ামী লীগের বিঘোষিত মূলনীতি বিরোধীই নয়, তার নির্বাচনী প্রতীক নৌকারও তাৎপর্যবিরোধী। নৌকা চালাইতে যেমন দুই কাতারের দাঁড়ী লাগে, গণতন্ত্রী রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তাই লাগে। যদি কোনো দিন নৌকার সব দাঁড়ী এক পাশে দাঁড় টানিতে শুরু করে, তবে সেদিন নৌকা আর যানবাহন থাকিবে না। হইবে সেটা মিউজিয়ামের দর্শনীয় বস্তু।’

আবুল মনসুর আহমদ’র এই বয়ান তাৎক্ষণিকভাবে কারো কারো কাছে তেতো মনে হইতে পারে। কিন্তু এটা তেতো তো নয়ই, বরং নিজেদের বোধোদয় ঘটানোর জন্য এটা একটা অমেয় কথন। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের গত ৭৫ বছরের রাজনীতির দিকে যদি আমরা খেয়াল করি, দেশ পরিচালনায় কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে কারা এলো, সেটা যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে আবুল মনসুর আহমদের বয়ান এবং পঞ্চাশ বছরের রাজনীতি সম্পর্কে তার অবলোকন কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তা শুধু আক্ষরিকভাবে নয় বাস্তবেও স্পষ্ট হয়।

রাজনীতির ৫০ বছরকে আবুল মনসুর আহমদ দেখেছেন বহুকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি জারি রেখে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বহু বর্ণিল বিভায় রাঙায়িত। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ এবং ভেতর ও বাইরে থেকে দেখার মুন্সিয়ানায় তিনি পারঙ্গম, অনন্যও বটে। নানা পরিচয়ে তিনি শুধু প্রস্ফুটিত হননি, সুবাসও ছড়িয়েছেন। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ তার বহুল আলোচিত এবং সর্বাধিক পঠিত বই। রাজনৈতিক সাহিত্য হিসেবে এই বই যেমন চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী, রাজনীতির দর্শনকে বুঝতেও পরিপূর্ণ সহায়ক ও অবশ্যপাঠ্য। বিশেষ করে উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীর রাজনীতির ধারা-গতিপ্রকৃতি ও কার্যকারণসমূহ অনুধাবনে বইটি প্রামাণ্য দলিলতুল্য।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে এগুলো বা এগুচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এগুবে তারও একটা পাঠ খুঁজে পাওয়া যায় আবুল মনসুর আহমদের লেখা পাঠে। তিনি লিখেছেন, ‘এমন অবস্থায় একদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে আরও বেশি জোর দিলেন। অপর দিকে বিরোধী দলসমূহের কোন দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হইবেন, তাই লইয়া তারা বিতর্কে অবতীর্ণ হইলেন। স্মরণযোগ্য যে, এই সময়ে কথা উঠিয়াছিল স্বয়ং মওলানা ভাসানীও নির্বাচনে দাঁড়াইবেন।

বিরোধী দল নির্বাচনে জয়লাভ করিলে জনাব আতাউর রহমান খানই প্রধানমন্ত্রী হইবেন, অধিকাংশ দলের মতে এটা ঠিক হইয়াই ছিল। আওয়ামী লীগের কল্পিত আনপপুলারিটি যখন বিরোধী দলসমূহের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল, তখন মওলানা সাহেবের দলের এক নেতা প্রকাশ্যভাবেই বলিয়া ফেলিলেন যে মওলানা সাহেবের জনপ্রিয়তার সুযোগ লইয়া যেখানে বিরোধী দল নির্বাচনে জিতিতেছে, সেখানে মওলানা সাহেব প্রধানমন্ত্রী না হইয়া অপরে প্রধানমন্ত্রী হইবেন কেন?’

স্বাধীনতার ঊষালগ্নের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেন বদলেছে, কেন বদলায়নি, এ দায় কার-এসব নিয়েও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কেননা রাজনীতি যেহেতু নীতির রাজা এবং তার প্রযত্নেই সম্পন্ন হয় সমাজ-রাষ্ট্রের যাবতীয় রুটিনওয়ার্ক এবং বিধি ও বিধান, রাজনীতির ভেতরেই বাস করে রাষ্ট্রনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-ধর্মনীতি-সংস্কৃতিসহ যাবতীয় সবকিছুই। আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বই এই সত্যকে ধারণ করেছে এবং রাজনীতিকে কেন্দ্রে রেখে সবদিকে আলো ফেলেছেন।

এই আলো কখনো ব্যক্তিকে, কখনো পরিবারকে, কখনো এ সবের বাইরের বৃহত্তর পরিমণ্ডলকেও আলোকিত করেছে। এ আলো আমরা অর্ধ শতাব্দীর কিংবা তার চেয়েও কিছুটা বেশি সময়ের সমাজ-রাষ্ট্রের বিবর্তন ও সোনালী অতীতের রুঢ় বাস্তবতা খুঁজে পাই আবুল মনসুর আহমদের অবলোকনে, যা জানা-বোঝা কেবল জরুরি নয়, কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে এবং নিজেদের আলোকিত বর্তমান নিশ্চিত করতে মোক্ষম ও যথার্থ এক দাওয়া।

আবুল মনসুর আহমদ যেহেতু একজন গল্পকার এবং স্যাটায়ারিস্ট, তাই তার দেখার চোখ অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। আবার তিনি যেহেতু একজন সাংবাদিক এবং সম্পাদক, তাই তিনি শুধু একজন প্রতিবেদকের দৃষ্টিতে দেখেন না, ‘ফাইভ ডব্লিউ অ্যান্ড ওয়ান এইচের’ ব্যবহারের পাশাপাশি তাতে গল্পের আবেদনটাকেও যুক্ত করেন। আবার আইনজীবী হওয়ার কল্যাণে যুক্তি-তর্ক এবং পাল্টা যুক্তি ও উদাহরণকেও আশ্রয় দেন, বিষয় সংশ্লিষ্ট করেন।

রাজনীতিবিদ হওয়ার সুবাদে সেখানে তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ, জনগণের সুবিধা, দেশের কল্যাণ এবং বর্তমানে তার প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যতে তার প্রভাব-মঙ্গল-অমঙ্গল সব কিছুকেই অনিবার্য এক অনুষঙ্গ করে তোলেন। এখানেই তার লেখালেখির বিশেষত্ব। এ সব গুণের কারণেই তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক কথাকার কিংবা রাজনৈতিক সাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবে স্মরণীয় নন, রাজনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা হিসেবেও বিশেষ মহিমা ও মর্যাদার দাবি রাখেন।

ড. কাজল রশীদ শাহীন: লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment